ফারাক্কা বাঁধ ও বাংলাদেশ

দেশের দক্ষিণ-পশ্চিম, উত্তর-পূর্ব মধ্যাঞ্চলের সকল নদ-নদীর পানি আসে গঙ্গা, ব্রহ্মপুত্র, তিস্তা ও মেঘনা থেকে। এসব নদী এবং এর উপনদীগুলোর উৎপত্তি প্রতিবেশী দেশ ভারত, নেপাল, তিববত (চীন) ও ভুটানে অবস্থিত হিমালয়ের হিমবাহ থেকে। এগুলো আন্তর্জাতিক নদী।

এই নদীগুলোর পানি কোন দেশের একক সম্পদ নয় বরং এসব নদীর পানিপ্রবাহ সকল দেশের ঐক্যমতের ভিত্তিতে সুষম বণ্টনের ক্ষেত্রে আন্তর্জাতিক আইন ও নীতিমালা রয়েছে। কিন্তু ভারত সরকার আন্তর্জাতিক কোন আইনের তোয়াক্কা না করে বরং পেশিশক্তির জোরে গঙ্গা নদীর ওপর ফারাক্কা বাঁধের মত উচ্চাভিলাসী প্রকল্প চালু করে পুরো বাংলাদেশের বেশিরভাগ অঞ্চলে আজ পানির জন্য হাহাকার অবস্থা বিরাজ করাচ্ছে।

ফারাক্কা বাঁধ পরিকল্পনা করা হয় ১৯৫১ সালে। নির্মাণকাজ শুরু হয় ১৯৬১ সালে এবং শেষ হয় ১৯৭০ সালে। বাঁধ পরীক্ষামূলকভাবে চালু হয় ১৯৭৪ সালে।

১৯৭১ সনে বানানো ২,২৫০ মিটার লম্বা ড্যাম এই ফারাক্কা, যেটা প্রায় এক বিলিয়ন ডলার ব্যায়ে সোভিয়েত রাশিয়ার সহায়তায় বানানো হয়েছিল। একই প্রকল্পের অংশ জঙ্গিপুর ক্যানেল, যেটা দিয়া গঙ্গা থেকে হুগলি নদীতে পানি সরানোর কাজ শুরু করে ইনডিয়া ১৯৭৫ সনে।

  • বাঁধের দৈর্ঘ্য ২.২৫ কিলোমিটার।
  • সংযোগ খালের দৈর্ঘ্য ৪৩ কিলোমিটার।
  • সংযোগ খালের পানি প্রবাহের ক্ষমতা ৪০,০০০ কিউসেক।
  • গেটের সংখ্যা ১০৯টি

১৯৭১ সনে বানানো ২,২৫০ মিটার লম্বা ড্যাম এই ফারাক্কা, যেটা প্রায় এক বিলিয়ন ডলার ব্যায়ে সোভিয়েত রাশিয়ার সহায়তায় বানানো হয়েছিল। একই প্রকল্পের অংশ জঙ্গিপুর ক্যানেল, যেটা দিয়া গঙ্গা থেকে হুগলি নদীতে পানি সরানোর কাজ শুরু করে ইনডিয়া ১৯৭৫ সনে

 

সেই থেকে এ পর্যন্ত এ বাঁধ বাংলাদেশে যে বিপর্যয় সৃষ্টি করেছে, তাতে বিশেষজ্ঞদের অভিমত সত্য বলে প্রতিভাত হয়েছে। ফারাক্কা বাঁধের কারণে প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষভাবে বাংলাদেশের কতটা ক্ষতি হয়েছে এবং তার অর্থমূল্য কত হতে পারে তা নির্ণিত না হলেও অনেকেই মনে করেন, এত ক্ষতি হয়েছে যে, তা নির্ণয়যোগ্য নয়। প্রাকৃতিক ব্যবস্থা, মানবিক কাজকর্ম ও আর্থ-সামাজিক অবস্থার ওপর অপূরণযোগ্য ক্ষতি হয়েছে। উত্তরাঞ্চলে মরু ও দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলে লবণাক্ততার বিস্তার ঘটেছে  ।

নদীমাতৃক বাংলাদেশে ছোটবড় সব মিলিয়ে ২৩০টিরও বেশি নদ-নদী রয়েছে। এছাড়াও, ছড়া নদী, খাল-বিল, হাওড়-বাওড় ইত্যাদি রয়েছে অসংখ্য। এসব নদীর মধ্যে ৫৭টি হল আন্তর্জাতিক যার মধ্যে ৫৪টির মূল উৎস তিববত (চীন), নেপাল, ভুটান ও ভারতের পর্বতময় অঞ্চল থেকে। বাকি ৩টি মিয়ানমার থেকে এসেছে। বাংলাদেশের অবস্থান ভাটি অঞ্চলে হওয়ায় উজানে যে কোন ধরনের পানি নিয়ন্ত্রণের প্রত্যক্ষ প্রভাব বাংলাদেশের ওপরই বর্তাবে। কিন্তু সেদিকে কর্ণপাত না করে কোলকাতা বন্দরের নাব্যতা বৃদ্ধির অজুহাতে ভারত পশ্চিমবঙ্গের মুর্শিদাবাদ জেলার রাজমহল ও ভগবানগোলার মাঝে ফারাক্কা নামক স্থানে এই জুলুমের বাধ নির্মাণ করে ভারত ।

 

ইতিহাস

ব্রিটিশ সরকার পলি সঞ্চয়ের কারণে কলকাতা বন্দরে জাহাজ ভিড়ানোর অসুবিধা লক্ষ্য করছিলেন। কারণ হুগলী-ভাগরথী নদী ক্রমশঃ নাব্যতা হারাচ্ছিল। গাঙ্গের অববাহিকায় ছোট ও মাঝারি আকারের শাখা নদীর স্বাভাবিক মৃত্যু কোন অস্বাভাবিক বিষয় নয়। এখানে অতীতে অনেক নদীরই প্রাকৃতিক নিয়মে এই নিয়তি ঘটেছে। কলকাতা থেকে ক্যানিং এ বন্দর স্তানান্তর করার চেষ্টা করা হয়েছিল তখন।

দেশ বিভাগের পর ভারত সরকারও হলদিয়াতে বন্দর স্থাপন করেছে। ১৮৫১ সাল থেকে ১৯৪৬ সাল অবধি কমপক্ষে পাঁচটি সমীক্ষা করা হয়েছে কিভাবে গঙ্গার পানির এক অংশ ঘুরিয়ে হুগলী-ভাগরথীতে প্রবাহিত করে পলি অপসারণ করা যায়।

বাঁধের পরিকল্পনা করা হয় ১৯৫১ সালে। নির্মাণকাজ শুরু হয় ১৯৬১ সালে এবং শেষ হয় ১৯৭০ সালে। বাঁধ পরীক্ষামূলকভাবে চালু হয় ১৯৭৪ সালে।

 

সমীক্ষায় বিশেষজ্ঞরা অভিমত প্রকাশ করেন যে গঙ্গা/পদ্মার মত বিশাল নদীর গতি বাঁধ দিয়ে বিঘ্নিত করলে নদীর উজান এবং ভাটি উভয় অঞ্চলে প্রাকৃতিক ভারসাম্য মারাত্মকভাবে নষ্ট হতে পারে। এ ধরণের নেতিবাচক অভিমত সত্ত্বেও ১৯৫৭ সালে ভারত সরকার ফারাক্কায় গঙ্গার উপর বাঁধ নির্মাণ ও হুগলী-ভাগরথীতে সংযোগ দেয়ার জন্য ফিডার খাল খননের পরিকল্পনা করে।

পশ্চিম বঙ্গের তদানীন্তন চীফ ইঞ্জিনিয়ার শ্রী কপিল ভট্টাচার্য এই পরিকল্পনার বিরোধিতা করে নিম্নরূপ অভিমত প্রকাশ করেন।

  • গঙ্গা থেকে অপসারিত ৪০,০০০ কিউসেক পানি ফিডার খাল কিম্বা হুগলী-ভাগরথী ধারণ করতে পারবে না।
  • গঙ্গা এবং ভাগরথীর প্রবাহ রেখার উচ্চতার তারতম্যের কারণে পানি সঞ্চালন কষ্টকর হবে। ফলে গঙ্গা নদী তার স্বাভাবিক প্রবাহের জন্য অন্য পথ খুঁজবে।
  • প্রথমোক্ত কারণের জন্য মুর্শিদাবাদ এবং মালদা জেলা জুড়ে দেখা দিবে জলাবদ্ধতা।
  • ব্রক্ষপুত্রের তুলনায় গঙ্গা কম গতি শক্তি সম্পন্ন নদী। এ ধরণের নদীর গতিপথ হয় আঁকা-বাঁকা (meandering)। এক বাঁক থেকে আরেক বাঁকের দূরত্বকে বলে মিয়ান্ডার দৈর্ঘ্য এবং একটি নির্দিষ্ট দূরত্বের মধ্যে কয়টা বাঁক রয়েছে তাকে বলে মিয়ান্ডার ফ্রিকোয়েন্সি। হঠাৎ করে মৃতপ্রায় হুগলী-ভাগরথীর মধ্য দিয়ে কৃত্রিমভাবে বিপুল পরিমাণে পানি প্রবাহিত করলে হুগলী-ভাগরথী ও উজানে বিহার অবধি সব নদীর মিয়ান্ডার ফ্রিকোয়েন্সির উপর বিরুপ প্রভাব পড়বে। ফলে ঐ সমস্ত নদীতে জলাবদ্ধতা, নদী ভাঙ্গন এবং চর সৃষ্টি তরান্বিত হবে।
  • ভাটি অঞ্চলের সকল নদীর নাব্যতা মারাত্মকভাবে বিঘ্নিত হবে।
  • শুষ্ক মওসুমে পানি প্রবাহ কম হওয়ার কারণে জলবায়ুর পরিবর্তন দেখা দিবে।

 

 

পদ্মা এবং তার শাখা প্রশাখা ১৯৬০ সালের তুলনায় নাব্যতা হারিয়েছে প্রায় ৭০%। বহু ছোট নদী শুকিয়ে গেছে কিম্বা মৃতপ্রায়। এককালের প্রমত্তা মধুমতি-গড়াই শীতের সময় ক্ষীণ ধারা। আশির দশকে একবার গড়াই সম্পূর্ণ শুকিয়ে গিয়েছিল। ১৯৮০-৮৮ সাল এই সময়টা ধরে, উপমহাদেশের বিশিষ্ট নদী বিশারদ মরহুম প্রফেসর এম, আই চৌধুরী এবংসৈয়দ সফিউল্লাহ জাতিসংঘ পরিবেশ অধিদপ্তর ও হামবুর্গ বিশ্ববিদ্যালয়ের যৌথ উদ্যোগে অনুষ্ঠিত ‘গ্লোবাল কার্বন প্রবাহ’ গবেষণা প্রকল্পে  হাতে নেন । প্রকল্পটার উদ্দেশ্য ছিল –

  1. বিশ্বের প্রধান নদীগুলো দিয়ে কতটা কার্বন প্রবাহিত হয়ে সমুদ্রে নিপতিত হয় এবং তা গ্রীন হাউস প্রতিক্রিয়ার বিপরীতে কতটা কাজ করে।
  2. বিশ্বের প্রধান নদীগুলোতে মানুষের কার্যকলাপের পরিপ্রেক্ষিতে নদীর স্বাভাবিক স্বাস্থ্যের ব্যাঘাত ঘটছে কিনা। ১৯টি বায়োজিও কেমিক্যাল প্যারামিটার মনিটর করে নদীর এই অবস্থা জানার সিদ্ধান্ত হয়।
  3. পলিপ্রবাহ এবং তার সাথে নিউট্রিয়েন্ট ও মিনারেল প্লাবন সমতলে ও সাগরের জীব উৎপাদন ব্যবস্থা কিভাবে প্রভাবিত করছে।

আমাদের গবেষণার কার্যক্ষেত্র ছিল পদ্মা-ব্রক্ষপুত্র-মেঘনা প্রণালীবদ্ধ এবং তার অববাহিকা। ৮ বছরের সমীক্ষার ফলাফল সংক্ষেপে নিম্নোরূপ :

পদ্মা এবং তার শাখা প্রশাখা ১৯৬০ সালের তুলনায় নাব্যতা হারিয়েছে প্রায় ৭০%। বহু ছোট নদী শুকিয়ে গেছে কিম্বা মৃতপ্রায়। এককালের প্রমত্তা মধুমতি-গড়াই শীতের সময় ক্ষীণ ধারা। আশির দশকে একবার গড়াই সম্পূর্ণ শুকিয়ে গিয়েছিল। ১৯৮০-৮৮ সাল এই সময়টা ধরে, উপমহাদেশের বিশিষ্ট নদী বিশারদ মরহুম প্রফেসর এম, আই চৌধুরী এবং আমি জাতিসংঘ পরিবেশ অধিদপ্তর ও হামবুর্গ বিশ্ববিদ্যালয়ের যৌথ উদ্যোগে অনুষ্ঠিত ‘গ্লোবাল কার্বন প্রবাহ’ গবেষণা প্রকল্পে অংশ গ্রহণ করি। প্রকল্পটার উদ্দেশ্য ছিল –

    1. বিশ্বের প্রধান নদীগুলো দিয়ে কতটা কার্বন প্রবাহিত হয়ে সমুদ্রে নিপতিত হয় এবং তা গ্রীন হাউস প্রতিক্রিয়ার বিপরীতে কতটা কাজ করে।
    2. বিশ্বের প্রধান নদীগুলোতে মানুষের কার্যকলাপের পরিপ্রেক্ষিতে নদীর স্বাভাবিক স্বাস্থ্যের ব্যাঘাত ঘটছে কিনা। ১৯টি বায়োজিও কেমিক্যাল প্যারামিটার মনিটর করে নদীর এই অবস্থা জানার সিদ্ধান্ত হয়।
    3. পলিপ্রবাহ এবং তার সাথে নিউট্রিয়েন্ট ও মিনারেল প্লাবন সমতলে ও সাগরের জীব উৎপাদন ব্যবস্থা কিভাবে প্রভাবিত করছে।
    1. আমাদের গবেষণার কার্যক্ষেত্র ছিল পদ্মা-ব্রক্ষপুত্র-মেঘনা প্রণালীবদ্ধ এবং তার অববাহিকা। ৮ বছরের সমীক্ষার ফলাফল সংক্ষেপে নিম্নোরূপ :
      1. পদ্মা নদী দিয়ে পলিপ্রবাহ প্রায় ২০% কমে গেছে (১৯৬০ সালের তুলনায়)।
      2. কার্বন প্রবাহ কমেছে ৩০%।
      3. পলিপ্রবাহ কমে যাওয়ার কারণে জমির উর্বরা শক্তি কমে যাচ্ছে।
      4. মিনারেল এবং নিউট্রিয়েন্ট কমে যাওয়ার ফলে নদী ও জলাভূমিতে ফাইটোপ্লাকটন উৎপাদন কমেছে ৩০%। ফাইটোপ্লাকটন হচ্ছে খাদ্য চক্রের প্রথম ধাপ। এ থেকে ক্রমান্বয়ে মাছ ও অন্যান্য জলজ জীবের উৎপাদন ঘটে। পদ্মা-ব্রক্ষপুত্রের সঙ্গমস্থল আরিচাঘাটে সমীক্ষা থেকে যে ফিশ ক্যালেন্ডার তৈরী করা হয়েছে তাতে দেখা যায় ৩৫ বছর আগের তুলনায় বর্তমান মৎস্য উৎপাদন মাত্র ২৫%। ইলিশ মাছ এখানে পাওয়া যায় না বল্লেই চলে। ইলিশ মাছ স্যাড গোত্রীয় মাছ। ০-৪২০ বিষ্ণুরেখার যেখানেই সমূদ্র সংলগ্ন নদী রয়েছে সেখানেই এই মাছ পাওয়া যায়। বৎসরের একটা নির্দিষ্ট সময়ে এই মাছ নোনা পানি থেকে মিঠা পানিতে আসে ডিম পাড়ার জন্য। উজানে এদের আগমন বাঁধ কিম্বা ঐ ধরনের বাধার পরিপ্রেক্ষিতে অত্যন্ত সংবেদনশলীল। ফারাক্কার আগে এক সময় রাজশাহী পদ্মা অবধি ইলিশ মাছ পাওয়া যেত। এখন আরিচাতেই এ মাছ পাওয়া যায় না। ফারাক্কা বিদ্যমান থাকলে আশংকা করা হয় পদ্মা এবং তার কমান্ড অঞ্চলে ইলিশ মাছ আদৌ পাওয়া যাবে না।
      5. জলবায়ু পরিবর্তন জনিত কারণে সমুদ্রের পৃষ্ঠের উচ্চতা বৃদ্ধি বাংলাদেশের বিরুদ্ধে দুধারী তলোয়ারের মত কাজ করছে। একদিকে সমুদ্র পৃষ্ঠের উচ্চতা বৃদ্ধির কারণে উপকুল অঞ্চল তলিয়ে যাওয়া আর তার সাথে যোগ হয়েছে বাংলাদেশের সমতল ভূমির ক্রমান্বয়ে দেবে যাওয়া যাকে বলা হয় সাবসিডেন্স। এর হার বছরে ৫ মি.মি.। নদীর প্লাবনের কারণে সঞ্চিত পলি সাবসিডেনসের নেতিবাচক প্রভাবকে এতকাল পুষিয়ে নিয়ে আসছিল। ফারাক্কার কারণে এমনটি আর হতে পারছে না।
      6. টোকিও বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রফেসর টোশিও ইসুজুকা ও আমাদের যৌথ গবেষণায় ষ্ট্রনসিয়াম আইসোটপ সমীক্ষার মাধ্যমে দেখতে সক্ষম হয়েছি যে পুরো বঙ্গোপসাগর জুড়ে সময় অনুচক্রে তীব্র ফাইটোপ্লাকটন বিকাশ ঘটে। আর এর অনুঘটক হচ্ছে নদী বাহিত নিউট্রিয়েন্ট বা পুষ্টি উপাদান ও মিনারেল। ফারাক্কা বাঁধের কারণে প্রক্রিয়াটি বিঘ্নিত হচ্ছে। ফলে সমগ্র বঙ্গোপসাগর জুড়ে মৎস্য উৎপাদন আশংকাজনকভাবে কমে যেতে পারে। বঙ্গোপসাগরের মাছের উপর ভারতের বিপুল জনগোষ্ঠিও নির্ভরশীল।একই সাথে কার্বন প্রতিস্থাপনের মাধ্যমে গ্রীন হাউস প্রতিক্রিয়ার উপশম কম হবে।
      7. সহকর্মী মরহুমা প্রফেসর কেট ক্র্যান্ক (কানাডা) এর সাথে যৌথ গবেষণায় আমরা দেখেছি যে ফারাক্কার কারণে নদী বাহিত পলির গ্রেইন সাইজ স্পেকট্রাল প্যার্টান অর্থাৎ পলি কণার সাইজ এর তাৎপর্যপূর্ণ পরিবর্তন ঘটছে। এই পরিবর্তন বাংলাদেশের মাটির ভৌত কাঠামোর উপর নেতিবাচক প্রভাব ফেলতে পারে।

      গোধূলী বেলায় পদ্মার মোহনীয় রুপ, যা এখন কেবলি স্বৃতি!

      নদীর লবণাক্ততা বৃদ্ধি

      আশির দশকে প্রথমদিকে আমার শিক্ষা গুরু প্রফেসর এম জেড হায়দারের তত্ত্বাবধানে রূপসা নদীর উপর অবস্থিত গোয়ালপাড়া তাপ বিদ্যুৎ কেন্দ্রের চীফ কেমিষ্ট সময়ের পরিপ্রেক্ষিতে রূপসা নদীর লবণাক্ততার পরিবর্তনের উপর পিএইচ.ডি গবেষণা করছিলেন। আমি সেই থিসিসের অ্যাডজুডিকেটর ছিলাম। ঐ গবেষণা হতে প্রাপ্ত উপাত্ত থেকে জানা যায় ১৯৬০ সালের তুলনায় ফারাক্কার কারণে আশির দশকে নদীর লবণাক্ততা ১২ থেকে ২৫ গুণ বৃদ্ধি পায়। পরিস্থিতি এমনি মরিয়া হয়ে উঠেছে যে ৬০ মাইল উত্তরে উজান থেকে মিঠা পানি সংগ্রহ করে তাপ বিদ্যুৎ কেন্দ্রটি চালু রাখতে হচ্ছে।

      সুন্দরবন

      সুন্দরবন সমগ্র মানবজাতির ঐতিহ্য হিসেবে আজ স্বীকৃত। সুন্দরবনের ইকো সিসটেমকে রক্ষণশীল বলে বিবেচনা করা হয় অর্থাৎ এই প্রণালীবদ্ধ পুষ্টি উপাদান যথাসম্ভব পুর্নব্যবহার করে। যদি কোন ঘাটতি থাকে তাহলে তা নদীবাহিত পলি থেকে আহোরিত হয়। এই ধরণের প্রণালীবদ্ধ লবণাক্ততা এবং পলি সঞ্চয়ের দৃষ্টিকোণ থেকে খুব সংবেদনশীল। ফারাক্কা বাঁধের ফলে সুন্দরবন অঞ্চলে পলি ও পানি প্রবাহে যে ব্যাঘাত ঘটেছে তার ফলে সুন্দরবনের অস্তিত্বই বিপন্ন হতে পারে।

      সমগ্র উত্তরাঞ্চল জুড়ে মরুকরণ

      পদ্মার পানি প্রবাহ মারাত্মকভাবে কমে যাওয়ায় উত্তর অববাহিকায় বিশেষ করে রাজশাহী, চাপাইনবাবগঞ্জ ভূগর্ভস্থ পানির প্রথম স্তর ৮-১০ ফুট জায়গা বিশেষে ১৫ ফুট নীচে নেমে গেছে। খরার মওসুমে প্রথম স্তর থেকে সেচ তো দূরের কথা পান করার পানিও উত্তোলন করা যাচ্ছে না। মওসুমী বৃষ্টি ও এই স্তরে রিচার্য করে কুলিয়ে উঠতে পারছে না। সেচের জন্য খরার মওসুমে এখন ভরসা দ্বিতীয় স্তর (>৩০০ ফুট)। বরেন্দ্র অঞ্চলে এই স্তরটা মোটামুটি ফসিল পানি দিয়ে পূর্ণ। ব্যাপক সেচের ফলে এই স্তর থেকে কতদিন পানি উত্তোলন করা যাবে কে জানে। পানির অভাবে মাটির আদ্রতা শুষ্ক মওসুমে ৩৫% কমে গেছে। পানি প্রবাহের এমন করুণ অবস্থা থেকে সৃষ্ট হয় মরুকরণ প্রক্রিয়া। নদীর পানি থেকে জলীয় বাষ্প সংশ্লিষ্ট অঞ্চলের বায়ুর আদ্রতা সৃষ্টিতে নিয়ামক ভূমিকা পালন করে। খরার সময় পদ্মা নিজেই যখন বিশুষ্ক মরুভূমিতে পরিণত হয় সে তখন স্থলভূমির বায়ুতে আদ্রতার যোগান কিভাবে দিবে। আদ্রতার অভাবে দিনের নিম্নতম এবং উচ্চতম তাপমাত্রার তারতম্য বৃদ্ধি পায়। ৬০ দশকে এই তারতম্য যেখানে ৫-৮ সে. ছিল এখন সেটা বৃদ্ধি পেয়ে ৮-১২ সে. এ দাঁড়িয়েছে। এই দৃষ্টিকোণ থেকে মরুকরণ প্রক্রিয়ার ব্যাহিক রূপ এই অঞ্চলের জনগণ ইতিমধ্যে প্রত্যক্ষ করছেন। মরুকরণের অনেক বায়ো মার্কার রয়েছে, এইগুলো হতে পারে পানি নির্ভর উদ্ভিদ এবং আরো সুক্ষ স্তরে অণুজীব। আশা করা যায় দেশের নতুন প্রজন্মের পরিবেশ বিজ্ঞানীরা জাতীয় স্বার্থে এ ব্যাপারে গবেষণায় ব্রত হবেন।

 


Comments

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *