অবিভক্ত স্বাধীন বাংলা – United Bengal

অবিভক্ত স্বাধীন বাংলা কিংবা বৃহত্তর বাংলাদেশ  একটি বাঙালি জাতীয়তাবাদ কেন্দ্রিক ঐতিহাসিক রাজনৈতিক মতবাদ যা দক্ষিণ এশিয়ার সকল বাংলা   ভাষাভাষী মানুষের একটি কেন্দ্রীভূত স্বাধিন বাঙালি  রাষ্ট্র ব্যবাস্থার দাবি করে । ১৯ শতকে উদ্ভূত বাংলার নবজাগরণ এবং  স্বাধীনতা আন্দোলন, বাংলা ভাষা আন্দোলন, বাংলাদেশ মুক্তিযুদ্ধ এবং ১৯৭১ সালে বাংলাদেশ ও একটি অবিভক্ত স্বাধিন বাংলা সৃষ্টি পেছনে প্রধান অনুপ্রেরণা হিসাবে কাজ করছে।  বাঙালি জাতীয়তাবাদী রবিন্দ্রনাথ ঠাকুর , কাজী নজ্রুল ইসলাম , নেতাজি  সুভাষ চন্দ্র বসু , মাওলানা ভাসানি,হোসেন শহীদ সোহ্‌রাওয়ার্দী অবিভক্ত স্বাধিন বাংলা প্রতিষ্ঠার জন্য সংগ্রাম করেছেন ।

ব্রিটিশ রাজ ভারতে ক্যাবিনেট মিশন ১৯৪৬ প্রেরন করলে বেঙ্গল প্রেসিডেন্সির এ সময়ে বাংলার প্রধানমন্ত্রী হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দী আনুষ্ঠানিকভাবে অবিভক্ত বাংলাকে স্বাধীন ও সার্বভৌম রাষ্ট্র করার এক পরিকল্পনা পেশ করেন।নেতাজি সুভাষ চন্দ্র বসুর বড় ভাই শরৎচন্দ্র বসুও তাঁর সার্বভৌম সমাজতান্ত্রিক বাংলা প্রজাতন্ত্রের এক প্রস্তাব উত্থাপন করেন। ১৯৪৭ সালের ২৬শে এপ্রিল ইংরেজ বড়লাট মাউন্টব্যাটেনের সাথে এক সভায় হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দী উত্থাপন করেন অবিভক্ত স্বাধীন বাংলা প্রস্তাব। হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দি তার এই পরিকল্পনার পক্ষে সমর্থন সৃষ্টির জন্য মাউন্টব্যাটেনের কাছ থেকে দুমাস সময় চেয়ে নেন। মাউন্টব্যাটেন তাকে জানান যে তিনি দেশ বিভাগের বিরুদ্ধে, তবে ঐক্যবদ্ধ ভারত না হলে ক্যাবিনেট মিশনের প্রস্তাবকেই তিনি অগ্রাধিকার দেবেন । এর জন্য জনগণের পক্ষ থেকে কোন দাবি ছিল না। বাংলাদেশ বিভাগ ছিল বৃটিশ উপনিবেশিক শাসক শ্রেণির একটি কৌশলগত পদক্ষেপ যা তাদের ডিভাঈড এন্ড রুল দর্শনে বাঙ্গালিদের বিভিন্ন মতবাদে বিভক্ত করে শোষণ করার এক কৌশল মাত্র ।

১৭৫৭ সালে ইংরেজরা  মুলত যুদ্ধ না করে পলাশির ময়দানে  কূটনৈতিক কৌশল কে ব্যাবহার করে স্বাধিন বাংলা দখল করে  ।   বহু শতাব্দীর রাজনৈতিক, সামাজিক, সাংস্কৃতিক, অর্থনৈতিক বিবর্তন ধারায় গঠিত  বাংলা, বঙ্গদেশ বা বাংলাদেশকে বিভক্ত করে ১৯০৫ সালে ব্রিটিশরা পশ্চিমবঙ্গ ,  পূর্ববঙ্গ ও আসাম নামে নতুন প্রদেশ সৃষ্টি  করে ।  বাঙ্গালিদের ব্রিটিশ বিরোধী আন্দোলন কে দমন করতেই হিন্দু এবং মুসলিমদের বিভেদ বাড়িয়ে ।

বাঙালি জাতীয়তাবাদ

বাঙালি জাতীয়তাবাদ হল একটি রাজনৈতিক অভিব্যক্তি যার মাধ্যমে প্রাচীন কাল থেকে দক্ষিণ এশিয়ায় বসবাসরত বাঙালি জাতি, তথা বাংলা ভাষাগত অঞ্চলের অধিবাসীদের বুঝানো হয়ে থাকে। বাঙালি জাতি উপমহাদেশের একটি অন্যতম জাতীয়তাবাদী চেতনায় প্রভাবিত এক প্রভাবশালী জাতি। বাঙালি জাতীকে উপমহাদেশের ব্রিটিশ বিরোধী আন্দোলনের রূপকার বলা হয়ে থাকে। অবিভক্ত বাংলা পরবর্তীতে ব্রিটিশচক্রান্তে বিভক্ত করা হয়। প্রাচীন বঙ্গদেশ অর্থাৎ বাংলাদেশ ও ভারতের পশ্চিমবঙ্গত্রিপুরাঅসম ও আন্দামান ও নিকোবর দ্বীপপুঞ্জে বসবাসকারী মানব সম্প্রদায়ের একতাবদ্ধ জাতি রাষ্ট্রের রাজনৈতিক ধারনাকে অবিভক্ত স্বাধীন বাংলা বা বৃহত্তর বাংলাদেশ বলা হয়ে থাকে, যাদের ইতিহাস অন্ততঃ চার হাজার বছর পুরোনো

পলাশির যুদ্ধে ব্রিটিশদের জয়ের পর তারা বাংলায় চরম জুলুম শুরু করে । যখন সমগ্র ভারত ইংরেজদের সাথে হাত মিলিয়েছিল তখন শুধুমাত্র বাঙ্গালিরা এর চরম প্রতিবাদ করায় চলে নির্যাতন । যুদ্ধের পরেই রাজ্যের খাজনা বাড়িয়ে দেওয়া হয় ৫০ ভাগ । সকল উৎপাদিত শস্য ও খাবার বিদেশে বিক্রি করে দেয় ব্রিটিশ রা । পলাশির দশ বৎসর পর হয় সেই ” ছিয়াত্তরের মনান্তর ” ইংরেজিতে Great Bengal Famine of 1770 ।

এই দুর্ভিক্ষে প্রায় এক কোটিরো বেশি বাঙ্গালী না খেয়ে ক্ষুধার যন্ত্রণায় মারা যায় । ১৭৬৯ থেকে ১৭৭৩ সাল পর্যন্ত চলা এই দুর্ভিক্ষ ছিল সম্পূর্ণ ব্রিটিশ দের সৃষ্ট ।

Huseyn Shaheed Suhrawardy.png
হোসেন শহীদ সোহ্‌রাওয়ার্দী

দেবেন। ঐদিনই কায়েদে আজম জিন্নাহর সাথে সাথে মাউন্টব্যাটেনের এক বৈঠক হয়। সে বৈঠকে তিনি জিন্নাহকে জানান সোহরাওয়ার্দি তাকে বলেছেন যে ভারত বা পাকিস্তান কারো সাথে যোগ দেবে না এই শর্তে অবিভক্ত বাংলা থাকা সম্ভব। জিন্নাহ ঐক্যবদ্ধ স্বাধীন বাংলার প্রস্তাব সমর্থন করেন

১৯৪৭-এর ২০ মে অনুষ্ঠিত এক বৈঠকে স্বাধীন অবিভক্ত বাংলার পক্ষপাতী নেতাদের মধ্যে একটি চুক্তি সম্পাদিত হয়। চুক্তির শর্তগুলি ছিল নিম্নরূপ:

অবিভক্ত স্বাধিন বাংলা – বসু  সোহরাওয়ার্দী চুক্তি

Netaji Subhas Chandra Bose.jpg
সুভাষচন্দ্র বসু

১. বাংলা একটি স্বাধীন রাষ্ট্র হবে। স্বাধীন বাংলা রাষ্ট্র অবশিষ্ট ভারতের সঙ্গে তার সম্পর্ক নির্ধারণ করবে।

২. স্বাধীন বাংলা রাষ্ট্রের সংবিধানে যুক্ত নির্বাচন ও বয়স্ক ভোটাধিকারের ভিত্তিতে বাংলার ব্যবস্থাপক পরিষদের নির্বাচনের ব্যবস্থা থাকবে আর সে সঙ্গে হিন্দু ও মুসলমান জনসমষ্টির সংখ্যানুপাতে আসন সংরক্ষিত থাকারও ব্যবস্থা থাকবে। হিন্দু ও তফশিলি হিন্দুদের আসনগুলি তাঁদের নিজ নিজ সম্প্রদায়ের জনসমষ্টির অনুপাতে তাঁদের জন্য বণ্টনের ব্যবস্থা থাকবে কিংবা এমন ভাবে সে ব্যবস্থা করা হবে যাতে উভয় সম্প্রদায়ের সম্মতি থাকবে। নির্বাচনী এলাকাগুলি হবে কার্যত বহু নির্বাচনী এলাকা এবং ভোট হবে বণ্টন অনুসারে, সামগ্রিক নয়। নির্বাচন চলাকালে কোনো প্রার্থী তাঁর নিজ সম্প্রদায়ের সংখ্যাগরিষ্ঠ ভোট পেলে এবং একইভাবে প্রদত্ত অন্য সম্প্রদায়গুলির ২৫ শতাংশ ভোট পেলে তাঁকে নির্বাচিত ঘোষণা করা হবে। যদি কোনো প্রার্থী এ শর্তাবলি পূরণ না করতে পারেন তাহলে যিনি তাঁর সম্প্রদায়ের সর্বোচ্চ সংখ্যক ভোট পাবেন তিনিই নির্বাচিত হবেন।

৩. স্বাধীন বাংলা রাষ্ট্রের প্রস্তাব গৃহীত হয়েছে ও বাংলা বিভক্ত করা হবে না এ মর্মে ব্রিটিশ রাজকীয় সরকারের ঘোষণার পর বাংলার বর্তমান মন্ত্রিসভা ভেঙ্গে দেওয়া হবে। তদস্থলে একটি নতুন অন্তবর্তীকালীন মন্ত্রিসভা গঠিত হবে। এ মন্ত্রিসভায় মুসলিম ও হিন্দু সম্প্রদায়ের (তফশিলি হিন্দু ও হিন্দুসহ) সমান সংখ্যক সদস্য থাকবেন। তবে মুখ্যমন্ত্রী এ হিসেবের বাইরে থাকবেন। এ মন্ত্রিসভায় প্রধানমন্ত্রী হবেন একজন মুসলিম ও স্বরাষ্ট্র মন্ত্রী হবেন একজন হিন্দু।

৪. নতুন সংবিধানের আওতায় একটি আইন পরিষদ ও একটি মন্ত্রিসভা চূড়ান্ত পর্যায়ে গঠিত হওয়া সাপেক্ষে ইত্যবসরে হিন্দু সম্প্রদায়ের লোকজন (তফশিলি হিন্দুসহ) ও মুসলিম সম্প্রদায়ের সদস্যরা সামরিক বাহিনী ও পুলিশ বাহিনীসহ বিভিন্ন চাকরিতে সমান অংশের অধিকারী হবেন। আর এসব চাকরি-বাকরি করবেন বাঙালিরা।

৫. গণপরিষদ ত্রিশ বাক্তিকে নিয়ে গঠিত হবে। এদের মধ্যে ১৬ জন হবেন মুসলিম ও ১৪ জন অমুসলিম। ইউরোপীয়রা ছাড়া ব্যবস্থাপক পরিষদের মুসলিম ও অমুসলিম সদস্যরা তাদেরকে নির্বাচিত করবেন।

Sarat Chandra Bose.jpg
শরৎচন্দ্র বসু

স্বাধীন সার্বভৌম বাংলা সৃষ্টির জন্য ১৯৪৭ সালের ২০শে মে সোশ্যালিস্ট রিপাবলিকান পার্টির নেতা শরৎচন্দ্র বসুর বাড়িতে নেতা পর্যায়ে একটি ত্রিদলীয় আলোচনা সভা হয়। এ সভায় উপস্থিত ছিলেন তৎকালীন বাংলার মুখ্যমন্ত্রী সোহরাওয়ার্দি, মুহম্মদ আলী, ফজলুর রহমান, প্রাদেশিক মুসলিম লীগের সম্পাদক আবুল হাশিমআব্দুল মালেক, অবিভক্ত বাংলার কংগ্রেস পরিষদীয় দলের নেতা কিরণশঙ্কর রায়সত্যরঞ্জন বক্সী এবং শরৎচন্দ্র বসু। এ সভায় আবুল হাশিম ও শরৎ বসু সবার সাথে স্বাধীন সার্বভৌম বাংলা বাস্তবায়ন করার লক্ষ্যে এক চুক্তিতে স্বাক্ষর করেন। কিরণশঙ্কর রায় কংগ্রেস পার্টির দলের ঘোষিত নীতির বিরোধিতা করে এই প্রস্তাবের সাথে যুক্ত হন। সোহরাওয়ার্দি ও আবুল হাশিম একইভাবে মুসলিম লীগের ঘোষিত নীতির বিরুদ্ধে কাজ করেন। সোহরাওয়ার্দী ও শরৎ বসুর মধ্যে বাংলার সার্বভৌম মর্যাদা কি হবে তা নিয়ে মতপার্থক্য ছিল। কিন্তু তাঁদের উভয়েরই প্রাথমিক উদ্দেশ্য ছিল বাংলা প্রদেশের বিভক্তি রোধ করা।


বাংলার সশস্ত্র বিপ্লবী আন্দোলন (১৭৬০খ্রিঃ -১৯৪৭খ্রিঃ)

ফকির-সন্ন্যাসী আন্দোলন ১৭৬০-১৮১২ খ্রিস্টাব্দ

বাংলায় ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির আধিপত্যের বিরুদ্ধে মুসলিম ফকির (সুফি) ও হিন্দু যোগী সন্ন্যাসীদের সম্মিলিত সশস্ত্র প্রতিরোধ আন্দোলন। ১৭৬০ সালে এ আন্দোলন শুরু হয় এবং চার দশকেরও অধিককাল তা অব্যাহত থাকে। ফকির ও সন্ন্যাসীদের এই অব্যাহত প্রতিরোধের কারণ প্রকৃতই দুর্বোধ্য।

ফকির-সন্ন্যাসী বিদ্রোহের সংগঠক ও নেতা ছিলেন মাদারিয়া তরিকার সুফিসাধক মজনু শাহ। আঠারো শতকের মাঝামাঝি সময়ে তিনি বিহার ভিত্তিক মাদারিয়া সুফি তরিকার নেতা হিসেবে শাহ সুলতান হাসান সুরীয়া বুরহানার স্থলাভিষিক্ত হন। বিদ্রোহের নেতৃত্ব দানে তাঁর খলিফা ছিলেন সুফিসাধক মুসা শাহ, চেরাগ আলী শাহ, পরাগল শাহ, সোবহান শাহ, করিম শাহ প্রমুখ। ফকির-সন্ন্যাসী বিদ্রোহে সম্পৃক্ত জনৈক ভোজপুরী ব্রাহ্মণ ভবানী পাঠক তখন মজনু শাহর সঙ্গে যোগাযোগ রক্ষা করতেন। জমিদার দেবী চৌধুরানীর সঙ্গেও তাঁর যোগাযোগ ছিল। তিনি বিদ্রোহী সন্ন্যাসীদের নেতৃত্ব দেন বলেও ধারণা করা হয়।

১৭৬৭ সালের দিকে রংপুর, রাজশাহী, কুচবিহার, জলপাইগুড়ি ও কুমিল্লা জেলায় বিদ্রোহীদের আক্রমণ তীব্রতর হয়ে ওঠে। উত্তরবঙ্গে বিদ্রোহীদের তৎপরতা প্রতিহত করার জন্য ১৭৬৭ সালে ক্যাপ্টেন ডি. ম্যাকেঞ্জির অধীনে রংপুরে ইংরেজ বাহিনী প্রেরিত হয়। এ সময় মালদহের ইংরেজ রেসিডেন্ট বারওয়েল কর্তৃক মার্টলের নেতৃত্বে প্রেরিত একটি ইংরেজ বাহিনী বিদ্রোহীদের নিকট পরাজিত হয় এবং সেনাপতি মার্টল নিহত হন। ম্যাকেঞ্জির বাহিনীর আগমনের সংবাদ পেয়ে বিদ্রোহীরা নেপালের দিকে পশ্চাদপসরণ করে। ১৭৬৮ থেকে ১৭৭০ সালে প্রধানত শরণ (বিহার), বেনারস, পুর্নিয়া, রংপুর, দিনাজপুর, রাজশাহী, কুমিল্লা ও চট্টগ্রাম জেলায় ফকির-সন্ন্যাসীদের আক্রমণ অব্যাহত ছিল।

তিতুমীর ১৮২২ – ১৮৩১ সাল

তিতুমীর বর্তমান চব্বিশ পরগনানদীয়া এবং ফরিদপুরের বিস্তীর্ণ অঞ্চলের অধিকার নিয়ে সেখানে ব্রিটিশ শাসনের বিরুদ্ধে স্বাধীনতা ঘোষণা করেন। স্থানীয় জমিদারদের নিজস্ব বাহিনী এবং ব্রিটিশ বাহিনী তিতুমীরের হাতে বেশ কয়েকবার পরাজয় বরণ করে। তন্মধ্যে বারাসতের বিদ্রোহ অন্যতম। উইলিয়াম হান্টার বলেন, ঐ বিদ্রোহে প্রায় ৮৩ হাজার কৃষকসেনা তিতুমীরের পক্ষে যুদ্ধ করেন।[২]

১৮২২ - ১৮৩১ সাল 

অবশেষে ১৮৩১ সালের ১৩ নভেম্বর ব্রিটিশ সৈন্যরা তাদের চারদিক থেকে ঘিরে ফেলে। তিতুমীর স্বাধীনতা ঘোষণা দিলেন, “ভাই সব, একটু পরেই ইংরেজ বাহিনী আমাদের কেল্লা আক্রমণ করবে। লড়াইতে হার-জিত আছেই, এতে আমাদের ভয় পেলে চলবে না। দেশের জন্য শহীদ হওয়ার মর্যদা অনেক। তবে এই লড়াই আমাদের শেষ লড়াই নয়। আমাদের কাছ থেকে প্রেরণা পেয়েই এ দেশের মানুষ একদিন দেশ উদ্ধার করবে । আমরা যে লড়াই শুরু করলাম, এই পথ ধরেই একদিন দেশ স্বাধীন হবে।”[তথ্যসূত্র প্রয়োজন] ১৪ নভেম্বর কর্নেল হার্ডিং-এর নেতৃত্বে ব্রিটিশ সৈন্যরা ভারী অস্ত্রশস্ত্র নিয়ে তিতুমীর ও তাঁর অনুসারীদের আক্রমণ করে।[৮] তাদের সাধারণ তলোয়ার ও হালকা অস্ত্র নিয়ে তিতুমীর ও তাঁর সৈন্যরা ব্রিটিশ সৈন্যদের আধুনিক অস্ত্রের সামনে দাঁড়াতে পারেন নি। ১৪শে নভেম্বর তিতুমীর ও তাঁর চল্লিশ জন সহচর শহীদ হন। তাঁর বাহিনীর প্রধান মাসুম খাঁ বা গোলাম মাসুমকে ফাঁসি দেওয়া হয়। বাশেঁর কেল্লা গুঁড়িয়ে দেওয়া হয়


বাংলার  সিপাহী বিদ্রোহ ১৮৫৭

বিপ্লবী বাঙ্গালী যখন সুযোগ পেয়েছে তখনি আক্রমন করেছে ভিনদেশি দখলকারীদের ।  বাংলায় শুরু হয়া এই আন্দোলন তখন ভারতে ছড়িয়ে পড়ে ।

ব্রিটিশ ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানি প্রথমে শুধুমাত্র তাদের বাণিজ্যকুঠি-সংলগ্ন অঞ্চলগুলির প্রশাসন পরিচালনা করত। ১৭৫৭ সালে পলাশীর যুদ্ধে জয়লাভের পর পূর্ব ভারতে কোম্পানির শাসনের ভিত্তি দৃঢ় হয়। ১৭৬৪ সালে বক্সারের যুদ্ধে (বিহারে) জয়লাভের পর পরাজিত মুঘল সম্রাট দ্বিতীয় শাহ আলম কোম্পানিকে বাংলা, বিহার ও উড়িষ্যারদেওয়ানি (রাজস্ব আদায়ের অধিকার) প্রদান করতে বাধ্য হন।

সিপাহি বিদ্রোহকে বাংলার  প্রথম স্বাধীনতা যুদ্ধ, মহাবিদ্রোহ, বাংলার  বিদ্রোহ, ১৮৫৭ সালের বিদ্রোহ ও ১৮৫৮ সালের গণ-অভ্যুত্থান নামেও অভিহিত করা হয়ে থাকে। এই বিদ্রোহ দমন করা হয় নির্মমভাবে। বহু নিরপরাধ নরনারী, শিশু বৃদ্ধদের নির্বিচারে হত্যা করা হয়।

ফেব্রুয়ারী ১৮৫৭তে, সিপাহীরা (ব্রিটিশ সেনাবাহিনীতে  সৈন্য) নতুন কার্তুজ ব্যবহার করতে অস্বীকার করেছিল। ব্রিটিশ নতুন কার্তুজ প্রতিস্থাপন কর‍ার দাবী করেছিল এবং যা মৌমাছির তেল ও শাকসব্জী তেল থেকে তৈরী হবে। কিন্তু সিপাহীদের কাছে গুজব টিকে থেকেছিল।

এটা সারা বাংলাদেশ জুড়ে চরম উত্তেজনা সৃষ্টি করেছিল। চট্টগ্রাম ও ঢাকার প্রতিরোধ এবং সিলেট, যশোর, রংপুর, পাবনা ও দিনাজপুরের খণ্ডযুদ্ধসমূহ বাংলাদেশকে সর্তক ও উত্তেজনাকর করে তুলেছিল। ১৮৫৭ সালের ১৮ নভেম্বর চট্টগ্রামের পদাতিক বাহিনী প্রকাশ্য বিদ্রোহে মেতে ওঠে এবং জেলখানা হতে সকল বন্দিদের মুক্তি দেয়। তারা অস্ত্রশস্ত্র এবং গোলাবারুদ দখল করে নেয়, কোষাগার লুণ্ঠন করে এবং অস্ত্রাগারে আগুন ধরিয়ে দিয়ে ত্রিপুরার দিকে অগ্রসর হয়।

চট্টগ্রামে সিপাহিদের মনোভাব ঢাকার রক্ষা ব্যবস্থায় গুরুত্বপূর্ণ প্রভাব বিস্তার করে। সিপাহিদের আরও অভ্যুত্থানের আশঙ্কায় কর্তৃপক্ষ ৫৪তম রেজিমেন্টের তিনটি কোম্পানি এবং একশত নৌ-সেনা ঢাকায় প্রেরণ করে। একই সাথে যশোর, রংপুর, দিনাজপুরসহ বাংলাদেশের আরও কয়েকটি জেলায় একটি নৌ-ব্রিগেড পাঠানো হয়। প্রধানতঃ ইউরোপীয় বাসিন্দাদের নিয়ে গঠিত স্বেচ্ছাসেবীদের সংগঠিত করে ঢাকা রক্ষা করার জন্য বিশেষ ব্যবস্থা গ্রহণ করা হয়। নৌ-বিগ্রেড ঢাকা পৌঁছে সেখানে নিয়োজিত সিপাহিদের নিরস্ত্র করতে গেলে অবস্থা চরমে ওঠে। ২২ নভেম্বর লালবাগে নিয়োজিত সিপাহিগণকে নিরস্ত্র করতে গেলে তারা প্রতিরোধ সৃষ্টি করে। সংঘটিত খণ্ডযুদ্ধে বেশ কিছু সিপাহি নিহত ও বন্দি হয় এবং অনেকেই ময়মনসিংহের পথে পালিয়ে যায়। অধিকাংশ পলাতক সিপাহিই গ্রেপ্তার হয় এবং অতিদ্রুত গঠিত সামরিক আদালতে সংক্ষিপ্ত বিচারের জন্য তাদের সোপর্দ করা হয়। অভিযুক্ত সিপাহিদের মধ্যে ১১ জন মৃত্যুদণ্ড এবং বাকিরা যাবজ্জীবন কারাদণ্ডে দণ্ডিত হয়। এ রায় দ্রুত কার্যকর করা হয়।

বিভিন্ন অংশে, বিশেষ করে সিলেট, ময়মনসিংহ, দিনাজপুর এবং যশোরে চাপা ও প্রকাশ্য উত্তেজনা বিরাজমান ছিল। পলাতক সিপাহি ও ইউরোপীয় সৈন্যদের মধ্যে সিলেট এবং অপরাপর স্থানে কয়েকটি সংঘর্ষ ঘটে, যার ফলে উভয় পক্ষেই প্রাণহানি ঘটে। সিলেট এবং যশোরে বন্দি ও নিরস্ত্র সিপাহিদের স্থানীয় বিচারকদের দ্বারা সংক্ষিপ্ত বিচার করা হয়। ফাঁসি ও নির্বাসন ছিল এ সংক্ষিপ্ত বিচারের সাধারণ বৈশিষ্ট্য।

সিপাহি যুদ্ধের সময়ে বিভিন্ন শ্রেণীর মানুষের ভূমিকা ও প্রতিক্রিয়া একটি অনুজ্জ্বল চিত্র প্রতিফলিত করে। জমিদার-জোতদারগণ নিশ্চিতভাবে সিপাহিদের বিরুদ্ধে ছিলেন এবং তাদের মধ্যে কেউ কেউ গরু ও ঘোড়ার গাড়ি এবং হাতি সরবরাহ; পলায়নরত সিপাহিদের গতিবিধির সন্ধান প্রদান এবং চূড়ান্ত পর্যায়ে বিদ্রোহী সিপাহিদের প্রতিরোধ করার লক্ষ্যে স্থানীয় স্বেচ্ছসেবক বাহিনী গড়ে কোম্পানির স্থানীয় কর্তৃপক্ষকে কৌশলগত সমর্থন প্রদান করেন। সরকার কৃতজ্ঞতার সাথে জমিদার-জোতদারগণের এ সকল সেবার স্বীকৃতি প্রদান করে এবং পরে তাঁদেরকে নওয়াব, খান বাহাদুর, খান সাহেব, রায় বাহাদুর, রায় সাহেব প্রভৃতি উপাধিতে ভূষিত করে ও নানা পার্থিব সম্পদ দ্বারা পুরস্কৃত করে। জমিদার-জোতদারগণের প্রদর্শিত ভূমিকা অনুসরণ করে মধ্যবিত্ত শ্রেণীও কোম্পানির সরকারের পক্ষে অবস্থান গ্রহণ করে। সাধারণ মানুষ ও কৃষককুল সার্বিকভাবে এ বিষয়ে উদাসীন ছিল এবং সিপাহি যুদ্ধের স্পর্শ থেকে দূরে ছিল। তবে কৃত্রিম মূল্যবৃদ্ধির ফলে তারা যথেষ্ট ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছিল। এতদসত্ত্বেও এই মহাবিদ্রোহ আঠেরেশো শতকের পৃথিবীর সর্ববৃহৎ গণ অভ্যুত্থান হিসেবে চিহ্নিত হয়ে আছে যা ইংরেজ শাসনের ভিতকে কাঁপিয়ে দেয়। জাতীয়তাবাদী ঐতিহাসিক ও পন্ডিতেরা তাই একে সিপাহী বিদ্রোহের বদলে জাতীয় মহাবিদ্রোহ হিসেবে ব্যাখ্যা করেন।


বঙ্গভঙ্গ (১৯০৫)

বাংলার স্বাধানিতা আন্দোলনকে দুরবল করতে ব্রিটিশরা বঙ্গভঙ্গের প্রস্তাব দেয় । উন্নয়ন এর মুলা ঝুলিয়ে বাংলাকে আলাদা করার ষড়যন্ত্র হতে থাকে ।   বঙ্গভঙ্গ বাংলার ইতিহাসে একটি অতি গুরুত্বপূর্ণ অধ্যায়। ১৯০৫ সালের ১৬ই অক্টোবর ভারতের ভাইসরয় লর্ড কার্জনের আদেশে ১ম বঙ্গভঙ্গ সম্পন্ন হয়। ১৭৬৫ সালের পর থেকেই বিহার ও উড়িষ্যা বাংলার অন্তর্ভুক্ত ছিল।

File:Bengal (orthographic projection).svg

১৯০৩ সালে প্রথম বঙ্গভঙ্গের প্রস্তাবসমূহ বিবেচনা করা হয়। তখন বঙ্গ হতে চট্টগ্রামকে বিচ্ছিন্ন করা এবং ঢাকা ও ময়মনসিংহ জেলাদ্বয়কে আসাম প্রদেশে অন্তর্ভুক্ত করার একটি প্রস্তাবও ছিল। তেমনিভাবে ছোট নাগপুরকে মধ্যপ্রদেশের সঙ্গে আত্তিকরণেরও একটি প্রস্তাব ছিল।

পার্বত্য ত্রিপুরা রাজ্য, চট্টগ্রাম, ঢাকা ও রাজশাহী (দার্জিলিং বাদে) বিভাগ এবং মালদা জেলা, আসাম প্রদেশের সঙ্গে একীভূত হয়ে এই নতুন প্রদেশ গঠন করবে। এর ফলে বঙ্গ শুধু তার বৃহৎ পূর্বাঞ্চলই হারাবে না, তাকে হিন্দীভাষী পাঁচটি রাজ্যও মধ্যপ্রদেশকে ছেড়ে দিতে হবে। অন্যদিকে পশ্চিমে সম্বলপুর এবং মধ্যপ্রদেশের পাঁচটি ওড়িয়া-ভাষী রাজ্যের সামান্য অংশ বঙ্গকে দেওয়ার প্রস্তাব করা হয়। ফলে বঙ্গের আয়তন দাঁড়ায় ১,৪১,৫৮০ বর্গ মাইল এবং জনসংখ্যা ৫৪ মিলিয়ন যার মধ্যে ৪২ মিলিয়ন হিন্দু ও ৯ মিলিয়ন মুসলিম

নতুন প্রদেশটির নামকরণ করা হয় “পূর্ব বঙ্গ ও আসাম” যার রাজধানী হবে ঢাকা এবং অনুষঙ্গী সদর দফতর হবে চট্টগ্রাম। এর আয়তন হবে ১,০৬,৫৪০ বর্গ মাইল এবং জনসংখ্যা হবে ৩১ মিলিয়ন যাদের মধ্যে ১৮ মিলিয়ন মুসলিম ও ১২ মিলিয়ন হিন্দু। এর প্রশাসন একটি আইন পরিষদ ও দুই সদস্যবিশিষ্ট একটি রাজস্ব বোর্ড নিয়ে গঠিত হবে এবং কলকাতা হাইকোর্টের এখতিয়ার বজায় থাকবে। সরকার নির্দেশ দেয় যে পূর্ব বঙ্গ ও আসামের পশ্চিম সীমানা স্পষ্টভাবে নির্দিষ্ট থাকবে সাথেসাথে এর ভৌগোলিক, জাতিক, ভাষিক ও সামাজিক বৈশিষ্টাবলিও নির্দিষ্ট থাকবে। সরকার তাদের চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত ঘোষণা করে ১৯শে জুলাই, ১৯০৫ সালে এবং বঙ্গভঙ্গ কার্যকর হয় একই বছরের ১৬ই অক্টোবর।

এই ঘটনা এক প্রচণ্ড রাজনৈতিক অস্থিরতা সৃষ্টি করে। পূর্ব বঙ্গেরমুসলিমদের এই ধারণা হয় যে নতুন প্রদেশের ফলে শিক্ষা, কর্মসংস্থান ইত্যাদি ক্ষেত্রে তাদের সুযোগ বেড়ে যাবে। যদিও পশ্চিম বঙ্গের জনগণ এই বিভক্তি মেনে নিতে পারল না এবং প্রচুর পরিমাণে জাতীয়তাবাদী লেখা এই সময় প্রকাশিত হয়। ১৯০৫ সালে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর বঙ্গভঙ্গ রদ করার প্রস্তাবকদের জন্য এক মর্মস্পর্শী গান আমার সোনার বাংলা লেখেন,

এই সকল রাজনৈতিক প্রতিবাদের ফলশ্রুতিতে ১৯১১ সালে বঙ্গ আবার একত্রিত হয়। ভাষাতাত্ত্বিক এক নতুন বিভক্তির মাধ্যমে হিন্দি, ওড়িয়া এবং অসমীয়া অঞ্চলগুলো বঙ্গ হতে বিচ্ছিন্ন করে আলাদা প্রশাসনিক কাঠামোর আওতায় আনা হয়। এরই সাথে ব্রিটিশ ভারতেররাজধানী কলকাতা থেকে নয়া দিল্লীতে স্থানান্তর করা হয়।


বয়কট ও স্বদেশী আন্দোলনের ব্যর্থতা বাংলার স্বাধীনতাকামী দেশপ্রেমিক যুব সমাজকে সশস্ত্র বিপ্লবের পথে ঠেলে েদেয়। সশস্ত্র সংগ্রামের মাধ্যমে দেশ স্বাধীন করার যে গোপন তৎপরতার সূত্রপাত ঘটে, তাকেই বাংলার সশস্ত্র বিপ্লবী আন্দোলন বলা হয়ে থাকে। এই আন্দোলন ধীরে ধীরে বিভিন্ন অঞ্চলে অতর্কিত বোমা হামলা, উচ্চপদস্থ সরকারি কর্মচারী হত্যা, গেরিলা পদ্ধতিতে খণ্ডযুদ্ধ ইত্যাদি ঘটনার মধ্য দিয়ে প্রকাশ্যে চলে আসতে থাকে।

১৯১১ সাল থেকে ১৯৩০ সাল পর্যন্ত এই সংগ্রাম জোরদার হলেও এর অগেই সংগ্রাম শুরু হয়েছিল। ১৯০৮ খ্রিঃ ইংরেজ ম্যাজিস্ট্রেট কিংসফোর্ডকে হত্যা করার জন্য ক্ষুদিরামের বোমা হামলার মধ্য দিয়ে সশস্ত্র বিপ্লবী আন্দোলনব প্রকাশ্যে আত্মপ্রকাশ করে। এই আন্দোলন মূলত শেষ হয় ১৯৩০ সালে। তবে এর পরেও বিচ্ছিন্নভাবে সশস্ত্র আক্রমণের ঘটনা ঘটে।

১৯১১ খ্রিঃ বঙ্গভঙ্গ রদের আগেই বাংলার প্রথম পর্যায়ের সশস্ত্র আন্দোলন কিছুটা স্তিমিত হয়ে পড়ে। প্রথম পর্যায়ের শীর্ষস্থানীয় নেতাদের মধ্যে ছিলেন অরবিন্দ ঘোষ, রবীন্দ্র ঘোষ, ভূপেন্দ্র নাথ দত্ত প্রমুখ। পুলিন বিহারী দাস ছিলেন ঢাকার অনুশীলন সমিতির প্রধান সংগঠক। এঁরা বোমা তৈরি থেকে সব ধরনের অস্ত্র সংগ্রহসহ নানা ধরনের বিপ্লবী কর্মকাণ্ডের সঙ্গে জড়িত ছিলেন। সশস্ত্র আক্রমণ, গুপ্ত হত্যা ইত্যাদি কর্মসূচির মাধ্যমে এঁরা সরকারকেব ব্যতিব্যস্ত করে রাখে। অপরদিকে লেফটেন্যান্ট গভর্নর ফুলারকে হত্যার চেষ্টা করা হয়। ইংরেজ ম্যাজিস্ট্রেট কিংসফোর্ডকে হত্যার চেষ্টায় নিয়োজিত প্রফুল-চাকী আত্মহত্যা করে এবং ধরা পড়ার পর ক্ষুদিরামের ফাঁসি হয়। এছাড়া মানিকতলা বোমা হামলাসহ নানা অভিযোগে বেশ কয়েকজন বিপ্লবীকে ঐ সময় ফাঁসি দেওয়া হয়। বেশব কয়েকজন বিপ্লবীকে কারাবন্দী ও দ্বীপান্তরে প্রেরণ করা হয়। এই সমস্ত চরম দমননীতির কারণে প্রথম পর্যায়েব সশস্ত্র বিপ- স্থিমিত হয়ে যায়। দ্বিতীয় পর্যায়ে বিপ্লবী আন্দোলন শুরু হয় ১৯১২ খ্রিঃ। এই আন্দোলনবব কলকাতাকেন্দ্রিক হলেও ছড়িয়ে পড়ে পূর্ব বাংলার বিভিন্ন অঞ্চলেও। এই সময় বিপ্লবীরা আবার হত্যা, বোমা হামলা,ব ডাকাতি ইত্যাদি কার্যক্রম শুরু করেন। এই উদ্দেশ্যে কলকাতায় গোপনে বোমার কারখানা স্থাপন করা হয়। এর মধ্যে কলকাতা ও পূর্ব বাংলার যশোর, খুলনায় অনেকগুলো সশস্ত্র ডাকাতির ঘটনা ঘটে। ১৯১২ সালের শেষের দিকে দিল্লিত বিপ্লবী রাসবিহারী বসুর পরিকল্পনায় লর্ড হার্ডিংকে হত্যার জন্য বোমা হামলা চালানো হয়। হার্ডিং বেঁচে যান।বে কিন্তু বিপ্লবী রাসবিহারী বসুকে ধরার জন্য ইংরেজ সরকার এক লক্ষ টাকার পুরস্কার ঘোষণা করে।

প্রথম বিশ্বযুদ্ধের সুযোগে বাংলার অনেক বিপ্লবী বিদেশ থেকে গোপনে অস্ত্রব সংগ্রহের মতো দুঃসাহসী চেষ্টাও করেছেন। এঁদের উদ্দেশ্য ছিল ইংরেজ শক্তির সঙ্গে লড়াই করে দেশ স্বাধীন করা। এঁদের মধ্যে ছিলেন বাঘা যতীন (যতীন্দ্রনাথ মুখোপধ্যায়) ডা. যদুগোপাল মুখোপাধ্যায়, নরেন্দ্রনাথ ভট্টাচার্য প্রমুখ। এঁরা প্রথম বিশ্বযুদ্ধে ইংরেজ শক্তির প্রতিপক্ষ জার্মানি থেকে অস্ত্র সাহায্যের আশ্বাস পান। তবে সরকার গোপনে এ খবর জানতে পেরে কৌশলে বাঘা যতীনসহ তার সঙ্গীদের গ্রেফতারের ব্যবস্থা করে। গ্রেফতারের সময় পুলিশের সঙ্গে বন্দুক যুদ্ধে চিত্তপ্রিয় নামের, এক বিপ্লবী শহিদ হন। বাঘাব যতীন তিন বিপ্লবীসহ আহত অবস্থায় বন্দী হন। বন্দী থাকাকালে তাঁর মৃত্যুব হয়। বন্দী অপর দুই বিপ্লবীর ফাঁসি হয়, আর একজনকে যাবজ্জীবন কারাদণ্ডব দেয়া হয়।

মৃত্যুদণ্ড, যাবজ্জীবন কারাদণ্ড, নির্মম অত্যাচারও বিপ্লবীদের তাঁদের পথব থেকে সরিয়ে দিতে পারেনি। ইংরেজ সরকারের অধীনে চাকরিরত দেশীয় এবং বিদেশি উচ্চপদস্থ সরকারি কর্মকর্তাদের হত্যার পরিকল্পনা অব্যাহত থাকে। পুলিশের সঙ্গে খণ্ডযুদ্ধ, চোরাগুপ্তা হামলা, বোমাবাজি ক্রমাগত চলতে থাকে।

১৯১৬ খ্রিঃ ৩০ জানুয়ারি ভবানীপুরে হত্যা করা হয় পুলিশের ডেপুটি সুপার বসন্ত চট্টোপধ্যায়কে। এভাবে হত্যা, খণ্ড যুদ্ধের সংখ্যা বেড়ে গেলে ১৯১৬-১৭ খ্রিঃ প্রতিরক্ষা আইনে সরকার বহু লোককে গ্রেফতার করে। ১৯২২ সালে গান্ধীজির অসহযোগ আন্দোলন প্রত্যাহারের সঙ্গে সঙ্গে গ্রেফতার ও পুলিশি নির্যাতন বৃদ্ধি পায়। পাশাপাশি বৃদ্ধি পায় বিপ্লবীদের কর্মকাণ্ড। বিপ্লবীরা অত্যাচারী পুলিশ সদস্যদের হত্যার আহ্বান জানিয়ে ‘লালবাংলা’ শীর্ষক প্রচারপত্র প্রকাশবব করে। ১৯২৪ খ্রিঃ গোপীনাথ সাহা নামে একজন বিপ্লবী কলকাতার পুলিশ কমিশনারকে হত্যা করতে গিয়ে ভুল করেব অপর একজন ইংরেজকে হত্যা করে। এই হত্যাকাণ্ডের জন্য গোপীনাথকে ফাঁসি দেওয়া হয়। আলিপুর জোনের সুপার বন্দী বিপ্লবীদের পরিদর্শন করতে গেলে প্রমোদ চৌধুরী নামে একজন বিপ্লবীর রডের আঘাতে তিনি মৃত্যুবরণ করেন।বব ১৯২৪ খ্রিঃ অক্টোবর মাসে ইংরেজ সরকার বেঙ্গল অর্ডিন্যান্স জারি করে। এই অর্ডিন্যান্সের বলে বহু বিপ্লবী কারারুদ্ধব হলে বিপ্লবী কার্যক্রম অনেকটা স্তিমিত হয়ে আসে।ব

মহাত্মা গান্ধী ১৯৩০ সালে শুরু করেন আইন অমান্য আন্দোলন। এই আন্দোলনের সঙ্গে সঙ্গে বাংলায় বিপ্লবী কর্মকাণ্ডব আবার বৃদ্ধি পায়। উল্লেখ্য যে, সে সময় বিপ্লবী আন্দোলন বাংলায় সবচেয়ে বেশি শক্তিশালী ছিল এবং বাঙালিরা ইংরেজখব প্রশাসনকে ব্যতিব্যস্ত রেখেছে। বাঙালি তরুণরা মৃত্যুভয়কে তুচ্ছ করে বারবার সশস্ত্র অন্দোলনে ঝাঁপিয়ে পড়েছে।

মাস্টারদা,  সূর্য সেন

এমন একজন দুঃসাহসী বিপ্লবী ছিলেন চট্টগ্রামের মাস্টারদা, যাঁর আসল নাম সূর্য সেন (১৮৯৪-১৯৩৪)। কলেজব জীবনে তিনি বিপ্লবীদের সংস্পর্শে আসেন। স্নাতক ডিগ্রি লাভের পর তিনি উমাতারা উচ্চ ইংরেজি বিদ্যালয়ের শিক্ষকব হিসেবে যোগদান করেন। এর মধ্যেই তিনি মাস্টারদা নামে পরিচিত হয়ে উঠেন। এ সময় তিনি অম্বিকা চক্রবর্তী,

অনুরূপ সেন, নগেন সেনের সহায়তায় একটি বিপ্লবী সংগঠন গড়ে তোলেন। তাঁর সংগঠন এবং তিনি নিজে একের পরব এক সশস্ত্র কার্যক্রমের সঙ্গে যুক্ত হয়ে বারবার গ্রেফতার হলেও প্রমাণের অভাবে মুক্তি পেয়ে যান। চট্টগ্রামকে ব্রিটিশ শাসনমুক্ত করার জন্য গঠন করেন চট্টগ্রাম বিপ্লবী বাহিনী। পরে এই আত্মঘাতী বাহিনীর নাম হয় ‘চিটাগাঙ রিপাবলিকানব আর্মি’। এই বাহিনী একের পর এক সরকারি প্রতিষ্ঠানগুলো দখল করতে থাকে। শেষ পর্যন্ত সরকারি অস্ত্রাগার লুণ্ঠন করে। ‘স্বাধীন চিটাগাঙ সরকার’ -এর ঘোষণা দেওয়া হয় এবং একই সঙ্গে ব্রিটিশ সরকারের বিরুদ্ধে যুদ্ধ ঘোষণা করা হয়। এই যুদ্ধ ছিল অসম শক্তির যুদ্ধ। সূর্য সেনের বিপ্লবীদের বিরুদ্ধে ইংরেজ সরকার বিপুল বাহিনী নিয়োগ করে।ব চূড়ান্ত যুদ্ধ সংঘটিত হয় জালালাবাদ পাহাড়ে। গোলাবারুদ ফুরিয়ে গেলে বিপ্লবীরা পিছু হটতে বাধ্য হয়। বেশ কিছুব তরুণ বিপ্লবী এই খণ্ডযুদ্ধে এবং অন্যান্য অভিযানে নিহত হন। বিপ্লবীরা গ্রামের কৃষকদের বাড়িতে বাড়িতে আশ্রয় নেন।বব ১৯৩৩ খ্রিঃ সূর্য সেন গ্রেফতার হন। ১৯৩৪ খ্রিঃ সংক্ষিপ্ত ট্রাইবুনালের বিচারে তাকে ফাঁসির আদেশ দেওয়া হয়। চরম নির্যাতনের পর ১২ জানুয়ারি তাকে ফাঁসি দেওয়া এবং তার মৃতদেহ বঙ্গোপসাগরে ভাসিয়ে দেওয়া হয়।

সূর্য সেনের বিপ্লবী বাহিনীতে নারী যোদ্ধাও ছিলেন। তার মধ্যে উল্লেখ যোগ্য ছিলেন কল্পনা দত্ত ও প্রীতিলতাবখ ওয়াদ্দেদার। অসাধারণ মেধাবী ছাত্রী প্রীতিলতা ১৯০০ খ্রিঃ ইন্টারমিডিয়েট পরীক্ষায় প্রথম স্থান অধিকার করেন এবং ডিসটিংশন নিয়ে বি.এ পাস করেন। ইতোমধ্যে তিনি বিপ্লবী কর্মকাণ্ডের সঙ্গে জড়িয়ে পড়েন এবং সূর্য সেনের দলেরব সঙ্গে যুক্ত হন। অসম্ভব সাহসী নারী প্রীতিলতাকে তাঁর যোগ্যতার জন্য চট্টগ্রাম ‘পাহাড়তলী ইউরোপিয়ান ক্লাব’ আক্রমণের নেতৃত্ব দেওয়া হয়। সফল অভিযান শেষে তিনি তার সঙ্গী বিপ্লবীদের নিরাপদে স্থান ত্যাগ করতে সহায়তাব করেন। কিন্তু ধরা পড়ার আগে বিষপানে আত্মহত্যা করেন। প্রীতিলতা বাংলার সমস্ত বিপ্লবী আন্দোলনের ইতিহাসেব এক কিংবদন্তি হয়ে আছেন।

চট্টগ্রামের বিপ্লবীদের পাশাপাশি কলকাতায় যুগান্তর দলও যথেষ্ট সক্রিয় ছিল। ১৯৩০ খ্রিঃ ডালহৌসি স্কোয়ারে চার্লসব টেগার্টকে হত্যার প্রচেষ্টা ব্যর্থ হয়। ওই বছর ডিসেম্বরে এক অভিযানে নিহত হন কলকাতা রাইটার্স বিল্ডিংয়ে কারা বিভাগের ইন্সপেক্টর জেনারেল সিম্পসন। এর আগে বিনয় বসুর হাতে নিহত হন অত্যাচারী পুলিশ অফিসার লোম্যা। এই বিপ্লবী অভিযানের সঙ্গে জড়িত বিনয় ও বাদল আত্মহত্যা করে এবং দীনেশের ফাঁসি হয়। ঐ বছরই বাংলার গভর্নরব জ্যাকসনকে হত্যার প্রচেষ্টা ব্যর্থ হয়। এই প্রচেষ্টার সঙ্গে জড়িত বীনা দাসের যাবজ্জীবন কারাদণ্ড হয়। ১৯৩১ থেকে ১৯৩৩ খ্রিঃ পর্যন্ত সময়ের মধ্যে মেদেনীপুরে পরপর তিনজন ইংরেজ ম্যাজিস্ট্রেট বিপ্লবীদের হাতে নিহত হয়।ব

বিপ্লবীদের ব্যাপক তৎপরতা ১৯৩০ সালের মধ্যে কমে গেলেও চট্টগ্রামের বিপ্লবীরা এর পরও একের পর এক অভিযানবব চালিয়েছে। ১৯৩৪ খ্রিঃ ৭ জানুয়ারি চট্টগ্রামের পল্টন ময়দানে ইংরেজদের ক্রিকেট খেলার আয়োজনে সশস্ত্র আক্রমণ চালিয়ে বিপ্লবীরা নিজেদের অস্তিত্ব জানান দিতে সক্ষম হন। ঐদিনও দুজন বিপ্লবী নিহত হন এবং দুজন ধরা পড়লেবব তাদেরকে পরে হত্যা করা হয়।

সশস্ত্র আন্দোলন ব্যর্থতার কারণ

সশস্ত্র বিপ্লবী আন্দোলনের ব্যর্থতার পেছনে যেসব কারণ রয়েছে তার একটি হচ্ছে গণবিচ্ছিন্নতা। এই আন্দোলনব পরিচালিত হতো গুপ্ত সমিতিগুলোর দ্বারা। এর সঙ্গে যুক্ত ছিল কিছু সংখ্যক শিক্ষিত সচেতন যুবক। নিরাপত্তার কারণে সমস্ত বিপ্লবী কর্মকাণ্ড গোপনে পরিচালিত হতো। সাধারণ জনগণের এর সম্পর্কে ধারণা ছিলনা। সাধারণ মানুষেরব কাছে সশস্ত্র আক্রমণ, বোমাবাজি, হত্যাকাণ্ড এ সবই ছিল আতঙ্ক আর ভয়ের কারণ। ফলে সাধারণ মানুষ ছিল এদের কাছ থেকে অনেক দূরে।

বাংলার বৃহত্তর জনগোষ্ঠী মুসলিম সমপ্রদায় এই আন্দোলন থেকে দূরে ছিল। বিপ্লবীদের হিন্দু ধর্মীয় আচার-অনুষ্ঠানেরব প্রতি বাধ্যবাধকতা থাকায় অর্থাৎ গীতা স্পর্শ, কালীর সম্মুখে সংস্কৃত ধর্মীয় শে-ক উচ্চারণ করে শপথ গ্রহণ ইত্যাদিরা কারণে মুসলিম সমপ্রদায় এ আন্দোলনে যুক্ত হওয়াকে বাধা বলে মনে করে।

গুপ্ত সংগঠনগুলোকে নিরাপত্তা ও গোপনীয়তা রক্ষার জন্য ছোট ছোট দলে বিভক্ত হয়ে কাজ করতে হতো। সব দল সব বিষয়ে জানতে পারত না। ফলে পরস্পরের মধ্যে দূরত্ব সৃষ্টি হয়। এ কারণে অনেক সময় সবার সঙ্গে যোগাযোগ রক্ষা করে কোনো অভিযান সফল করা অসম্ভব হয়ে পড়ে। সমন্বয়ের অভাবে সাংগঠনিক দুবর্লতা দেখা দেয়। তাছাড়া, গুপ্ত সমিতিগুলো যার যার মতো করে কাজ করত। এক সমিতির সঙ্গে অন্য সমিতির কোনো যোগাযোগ ছিল না। ফলে সশস্ত্র বিপ-ব কোনো একক নেতৃত্ব না থাকায় আন্দোলন চলে সারা দেশে বিচ্ছিন্নভাবে। এই বিচ্ছিন্নতা আন্দোলনের ব্েযর্থতার কারণ হয়ে দাঁড়ায়।

তাছাড়া সরকারের কঠোর দমননীতি ও জনবিচ্ছিন্নতার কারণে বিপ্লবীরা নিরাশ্রয় এবং কোণঠাসা হয়ে পড়ে। বিভিন্নব সংগঠন ও নেতাদের মধ্যকার আদর্শের বিরোধ-বৈরিতা যেমন সশস্ত্র বিপ- কে দুর্বল করেছিল, তেমন এঁদের মধ্যে তীব্রব বিভেদের জন্ম দিয়েছিল। এ অবস্থায় বাংলার কমিউনিস্ট পার্টি সংগঠিত হলে অনেক বিপ্লবী এতে যোগদান করে।ব

সশস্ত্র বিপ- সফল না হলেও বিপ্লবীদের আত্মাহুতি, দেশপ্রেম, সাহস পরাধীন বাংলা তথা ভারতবাসীকে স্বাধীনতার পথবব দেখিয়েছিল। এ আন্দোলন প্রত্যক্ষভাবে সফল না হলেও বিপ্লবীদের আদর্শ পরবর্তী আন্দোলনসমূহে প্রেরণা যুগিয়েছিল।

স্বরাজ ও বেঙ্গল প্যাক্ট

১৯২২ খ্রিঃ মহাত্মা গান্ধী অসহযোগ আন্দোলন প্রত্যাহার করে নিলে কংগ্রেসের অনেক নেতা কারাগার থেকে মুক্তি লাভ করেন। এ সময় মুক্তিপ্রাপ্ত নেতা চিত্তরঞ্জন দাস (সি.আর. দাস) ও মতিলাল নেহরুর সঙ্গে কংগ্রেসের ভবিষ্যৎ আন্দোলনের কর্মপন্থা নিয়ে মতবিরোধ দেখা দেয়। সি. আর. দাস ও তাঁর সমর্থকরা নির্বাচনের মাধ্যমে ব্যবস্থাপক পরিষদগুলোতে যোগদানের পক্ষে ছিলেন। কারণ ঐ সময় অসহযোগ আন্দোলনের ব্যর্থতার কারণে আইন অমান্য আন্দোলনের পরিবশে না থাকায় তাঁরা এ ধরনের সিদ্ধান্ত গ্রহণ করেন। তাছাড়া তাঁদের উদ্দেশ্য ছিল আইনসভায় যোগ দিয়ে নিয়মতান্ত্রিক আন্দোলনের মাধ্যমে ১৯১৯ খ্রিঃ সংস্কার আইন অচল করে দেওয়া। কিন্তু কংগ্রেসের গোয়া সম্মেলনে তাঁদের এই প্রচেষ্টা ব্যর্থ হয়। এই অবস্থার পরিপ্রেক্ষিতে ১৯২২ খ্রিষ্টাব্দে কংগ্রেসের একাংশের সমর্থনে সি.আর. দাসের নেতৃত্বে গঠিত হয় স্বরাজ পার্টি। সি.আর. দাস হন এ দলের সভাপতি। মতিলাল নেহরু হন অন্যতম সম্পাদক।

কংগেসের অভ্যন্তরে যারা স্বরাজ লাভের জন্য স্বরাজ পার্টির সমর্থক ছিলেন, তাদেরকে পরিবর্তনপন্থী এবং যারা স্বরাজ পার্টির বিপক্ষে অংশ নেয় তাদের বলা হয় পরিবর্তনবিরোধী। এই দুই পক্ষের সঙ্গে শুধু আন্দোলনের পন্থা নির্ধারণের ধরন ছাড়া আর কোনো বিষয়ে কোনো বিরোধ ছিল না।

স্বরাজ দলের বিরোধীরা অসহযোগ আন্দোলনের ধারা বজায় রেখে আইন বয়কট করার সিদ্ধান্তে দৃঢ়প্রতিজ্ঞ থাকে। অপর দিকে স্বরাজ দল গঠনের পরপর বাংলার অনেক বিপ্লবী- সুভাষচন্দ্র বসু, হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দীসহ অনেকব যুবনেতা এতে যোগদান করেন।

স্বরাজ দলের কর্মসূচি :

এক. আইনসভায় প্রবেশ করে সরকারি কর্মকাণ্ডের বিরোধিতা করা এবং ১৯১৯ খ্রিষ্টাব্দে প্রণীত সংস্কার আইন অকার্যকর করে দেয়া;

দুই. সরকারি বাজেট প্রত্যাখ্যান করা এবং মন্ত্রিসভার পতন ঘটানো;

তিন. বিভিন্ন প্রস্তাব ও বিল উপস্থাপনের মধ্য দিয়ে জাতীয়তাবাদী চেতনা ও কর্মকাণ্ডকে জোরদার করা এবং

চার. বিদেশি শাসনকে অসম্ভব করে তোলা।

স্বরাজ দলের কার্যাবলি :

১৯১৯ খ্রিষ্টাব্দে ভারত শাসন আইন বা মন্টেগু চেমসফোর্ড সংস্কার আইন অনুযায়ী, ১৯২৩ খ্রিষ্টাব্দে দ্বিতীয়বারের মতো নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়। স্বরাজ দল তাদের কর্মসূচি অনুযায়ী নির্বাচনে অংশগ্রহণ করে আশাতীত সাফল্য অর্জন করে। বিশেষ করে বাংলা ও মধ্য প্রদেশে স্বরাজ দল এ নির্বাচনে কেন্দ্রীয় আইনসভায় সংখ্যাগরিষ্ঠ দল হিসেবে আত্মপ্রকাশ করে। মুসলমানদের সমর্থন লাভের কারণে আইন সভায় স্বরাজ দলের ভিত শক্ত হয় এবং কর্মসূচি অনুযায়ী সরকারের বিভিন্ন পদক্ষেপে বাধা সৃষ্টি করা সম্ভব হয়। বাংলায় স্বরাজ দলের অভূতপূর্ব বিজয়ের কৃতিত্ব ছিল দলের সভাপতি চিত্তরঞ্জন দাসের। তাঁর অসামপ্রদায়িক চেতনা, উদারনীতি বাংলার সংখ্যাগরিষ্ঠ মুসলিম জনগণের আস্থা অর্জনে সক্ষম হয়। মুসলিম সমপ্রদায়ের সমর্থন তাঁকে এবং তাঁর দলকে শক্তিশালী করে তোলে।

বেঙ্গল প্যাক্ট বা বাংলা চুক্তি (ডিসেম্বর, ১৯২৩ খ্রিঃ)

উপমহাদেশের রাজনীতিতে হিন্দু-মুসলিম সমস্যা গভীরভাবে উপলব্ধি করতে সক্ষম হয়েছিলেন স্বরাজ দলের নেতা চিত্তরঞ্জন দাস। ফলে বাংলায় হিন্দু-মুসলিম সমস্যা দূর করার জন্য এই দূরদর্শী, বাস্তববাদী নেতা যে চুক্তি সম্পাদন করেছিলেন, ইতিহাসে তা বেঙ্গল প্যাক্ট বা বাংলা চুক্তি নামে খ্যাত। এই সময়ে বাংলার ইতিহাসে প্রধান ঘটনাই ছিল বেঙ্গল প্যাক্ট। নিঃসন্দেহে তাঁর এই প্রচেষ্টা হিন্দু-মুসলিম ঐক্যের পথ প্রশস্ত করেছিল।

সি.আর. দাস ফর্মুলা নামে খ্যাত বাংলা চুক্তি সম্পাদনা করতে যেসব মুসলমান নেতা গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা গ্রহণ করেছিলেন তাঁদের মধ্যে উল্লেখ যোগ্য হচ্ছেন আব্দুল করিম, মুজিবুর রহমান, আকরম খান, মনিরুজ্জামান ইসলামাবাদী। এছাড়াখ স্যার আব্দুর রহিম, একে ফজলুল হক, হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দী সমঝোতা চুক্তি সম্পাদনে সহযোগিতা ও এতে স্বাক্ষর প্রদান করেন। অপরদিকে বাংলার কংগ্রেস নেতা সুভাষচন্দ্র বসু চুক্তিতে স্বাক্ষর করেন। তাঁদের সম্মিলিত উদ্যোগে বেঙ্গল প্যাক্ট আনুষ্ঠানিকভাবে গৃহীত হয়।

১৯২৩ খ্রিষ্টাব্দে ১৬ ডিসেম্বর স্বাক্ষরিত চুক্তিতে মুসলমানদের বিভিন্ন সুবিধা প্রদান করার শর্তই ছিল মূল বিষয়। যেমন:

এক. স্বায়ত্তশাসন প্রতিষ্ঠিত হলে বাংলার প্রত্যেক সমপ্রদায় নিজ নিজ অধিকার পাবে। লোকসংখ্যার অনুপাতে এ স্বতন্ত্র নির্বাচন প্রথায় বাংলাদেশ ব্যবস্থাপক পরিষদে প্রতিনিধিত্বের ব্যবস্থা হবে।

দুই : স্থানীয় স্বায়ত্তশাসিত প্রতিষ্ঠানগুলোতে প্রত্যেক জেলার সংখ্যাগরিষ্ঠ সমপ্রদায় শতকরা ৬০টি আসন পাবে এবং সংখ্যালঘু সমপ্রদায় শতকরা ৪০টি আসন পাবে।

তিন. সরকারি দপ্তরে মুসলমানদের জন্য শতকরা ৫৫ ভাগ চাকরি সংরক্ষিত থাকবে।

চার. কোনো সমপ্রদায়ের ধর্মীয় বিষয়ে আইন পাস করতে হলে আসনসভায় নির্বাচিত উক্ত সমপ্রদায়ের তিন-চতুর্থাংশ সদস্যের সমর্থন থাকতে হবে।

পাঁচ. মসজিদের সামনে গান-বাজনাসহ কোনো মিছিল করা যাবে না এবং গরু জবাই করার ব্যাপারে কোনোরূপ হস্তক্ষেপ করা হবে না।

বেঙ্গল প্যাক্টের অবসান

বাংলাদেশের রাজনীতি এবং সমাজে হিন্দু-মুসলমানের মধ্যে সামপ্রদায়িক সমপ্রীতি স্থাপনের দলিল ছিল বেঙ্গল প্যাক্ট বা বাংলা চুক্তি। এই চুক্তির কারণেই মুসলমানের আস্থা অর্জন করে স্বরাজ পার্টি নির্বাচনে সংখ্যাগরিষ্ঠতা লাভে সক্ষম হয়। অপরদিকে হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দী কলকাতার ডেপুটি মেয়র নির্বাচিত হন এবং মুসলমানরা কর্পোরেশনে চাকরি লাভে সক্ষম হয়। বাংলা তথা ভারতীয় উপমহাদেশের হিন্দু-মুসলমান সমস্যা সমাধানের উদ্দেশ্যে সি.আর দাসের এই পদক্ষেপ যেমন বাস্তবধর্মী ছিল, তেমন ছিল, প্রসংশনীয়। কিন্তু দুর্ভাগ্যক্রমে তিনি বেঁচে থাকতেই হিন্দু পত্রিকাগুলো, রক্ষণশীল হিন্দু-সমাজ, গান্ধীজির সমর্থক কংগ্রেস দল ও স্বরাজ দলবিরোধী হিন্দুরা ‘বেঙ্গল প্যাক্ট’- এর তীব্র বিরোধিতা করে। অপরদিকে, হিন্দু মহাসভার ‘শুদ্ধি’ ও ‘সংগঠন’ নামক আন্দোলন এবং মুসলমানদের ‘তাবলিগ’ ও ‘তানজিম’ নামক আন্দোলন সমপ্রদায়িক সমপ্রীতি বিনষ্ট করে। ১৯২৫ খ্রিঃ ১৬ জুন চিত্তরঞ্জন দাসের অকালমৃত্যুতে হিন্দু-মুসলিম ঐক্যের পথ চিরদিনের জন্য বন্ধ হয়ে যায়। এছাড়া কংগ্রেস এবং অন্যান্য নেতৃবৃন্দ ‘বেঙ্গল প্যাক্ট-এর বিষয়ে উদাসীন থাকে। পরের বছর অর্থাৎ ১৯২৬ খ্রিঃ কলকাতা এবং পরে ঢাকায় হিন্দু-মুসলিম দাঙ্গার কারণে উভয় সমপ্রদায়ের মধ্যকার সমপ্রীতি নষ্ট হলে এই চুক্তি বাস্তবায়নের সকল পথ রুদ্ধ হয়ে যায়।

লাহোর প্রস্তাবের পটভূমি

ব্যাঙ্গল প্যাক্ট অকার্যকর হলে হিন্দু-মুসলিম ঐক্যের সম্ভাবনা ব্যাহত হয়। ১৯২৮ খ্রিঃ নেহরু রিপোর্টের মাধ্যমে হিন্দু- মুসলিম সমঝোতার প্রচেষ্টাও ব্যর্থ হয় সংখ্যালঘু সমপ্রদায়ের জন্য পৃথক নির্বাচনের প্রশ্নে। জিন্নাহ দুই সমপ্রদায়ের মধ্যে ঐক্য স্থাপন প্রচেষ্টায় ব্যর্থ হয়ে ১৯২৯ খ্রিঃ উত্থাপন করেন তাঁর বিখ্যাত ১৪ দফা; এর মধ্যে মুসলমান সমপ্রদায়ের স্বার্থ সংরক্ষণের বিষয়টি বিশেষ গুরুত্ব লাভ করে। এসব ঘটনার পরিপ্রেক্ষিতে সামপ্রদায়িক চেতনা প্রবল হতে থাকে এবং দুই সমপ্রদায়ের মধ্যকার দূরত্ব ক্রমশ বৃদ্ধি পেতে থাকে। ১৯৩০ খ্রিঃ প্রকাশিত সাইমন কমিশনের রিপোর্ট সব রাজনৈতিক দল প্রত্যাখ্যান করে। ১৯৩০-১৯৩২ খ্রিঃ পর্যন্ত লন্ডনে আহূত পরপর তিনটি গোলটেবিল বৈঠকে বিভিন্ন সমপ্রদায়ের আসন সংরক্ষণের দাবির বিষয়ে একমত হতে না পারার কারণে সমঝোতা ছাড়াই পরিসমাপ্তি ঘটে। এ সময়ে বিভিন্ন সমপ্রদায়ের নেতৃবৃন্দ এই সমস্যা সমাধানের জন্য ব্রিটিশ প্রধানমন্ত্রীর উপর চাপ প্রয়োগ করেন। ব্রিটিশ প্রধানমন্ত্রী রামজে ম্যাকডোনাল্ড সমস্যা সমাধানের জন্য ‘সামপ্রদায়িক রোয়েদাদ’ ঘোষণা করেন। সেখানে বিভিন্ন সমপ্রদায়ের জন্য কিছু আসন সংরক্ষণের ব্যবস্থাসহ পৃথক নির্বাচনের সুযোগ দেওয়া হয়। ‘সামপ্রদায়িক রোয়েদাদ’

বিভিন্ন সমপ্রদায় ও দলের মধ্যে তীব্র বিরূপ প্রতিক্রিয়ার সৃষ্টি করে। তবে মুসলমানরা প্রতিবাদ সত্ত্বেও সামপ্রদায়িক রোয়োদাদ গ্রহণের সিদ্ধান্ত গ্রহণ করে। এরপর যুক্তরাষ্ট্রীয় সরকার পদ্ধতি এবং প্রাদেশিক স্বায়ত্তশাসন প্রবর্তনের বৈশিষ্ট্য সংবলিত ভারত শাসন আইন ১৯৩৫ খ্রিঃ ব্রিটিশ পার্লামেন্টে গৃহীত হয়। এই আইন ভারতবর্ষের শাসনতান্ত্রিক ইতিহাসে এক গুরুত্বপূর্ণ দলিল হলেও এই আইন অনুযায়ী যুক্তরাষ্ট্রীয় ব্যবস্থা প্রবর্তন করা সম্ভব হয়নি। কারণ জিন্নাহ এই আইনে প্রস্তাবিত যুক্তরাষ্ট্রীয় ব্যবস্থার সমালোচনা করেন। অপরদিকে কংগ্রেস সভাপতি রাজেন্দ্রপ্রসাদ এর তীব্র সমালোচনা করে বলেন, এই আইনে স্বায়ত্তশাসনের স্বাভাবিক অগ্রগতির কোনো লক্ষণ নেই। উভয় দলই ভারতের জন্য অধিকতর শাসনতান্ত্রিক ও রাজনৈতিক সংস্কার দাবি করে। অপরদিকে হিন্দু মহাসভা এই আইনের বিরোধিতা করে। দলগুলোর বিরূপ প্রতিক্রিয়া সত্ত্বেও ১৯৩৭ খ্রিঃ এই আইনের অধীনে প্রস্তাবিত প্রাদেশিক স্বায়ত্তশাসন ব্যবস্থা কার্যকর করা হয়। অপরদিকে প্রাদেশিক নির্বাচনে বেশিরভাগ প্রদেশে কংগ্রেস সংখ্যাগরিষ্ঠ আসনে জয়লাভ করে। এ অবস্থায় মুসলিম সংখ্যাগরিষ্ঠ প্রদেশগুলোতে মুসলিম লীগের সঙ্গে কোনো রকম আলোচনা ছাড়াই কংগ্রেস মন্ত্রিসভা গঠন করে। তাছাড়া কংগ্রেস সভাপতি জওহরলাল নেহরু নির্বাচন পরবর্তীকালে মন্তব্য করেন যে ভারতে দুটি শক্তির অস্তিত্ব লক্ষণীয়-একটি সরকার, অপরটি কংগ্রেস। তাঁর এ ধরনের মন্তব্য মুসলিম নেতাদের মধ্যে তীব্র বিরূপ প্রতিক্রিয়ার সৃষ্টি হয়। মি: জিন্নাহ যিনি দীর্ঘ সময় ধরে হিন্দু-মুসলিম ঐক্যের প্রচেষ্টা চালিয়েছিলেন। তিনি কংগ্রেস সভাপতির বক্তব্যের কারণে রাজনীতির ভিন্ন পথে অগ্রসর হন। ১৯৩৮ খ্রিঃ তিনি সিন্ধুতে প্রাদেশিক মুসলিম লীগ সভায় হিন্দু ও মুসলমান দুটি ভিন্ন জাতি বলে উল্লেখ করেন। এভাবে লাহোর প্রস্তাবের আগেই হিন্দু-মুসলমান আলাদা জাতি; এই চিন্তা করার ফলে তাদের জন্যখ আলাদা রাষ্ট্রের চিন্তারও প্রকাশ ঘটতে থাকে। এই প্রকাশের বাস্তব উদাহরণ হচ্ছে ১৯৪০ খ্রিঃ লাহোর প্রস্তাব।

লাহোর প্রস্তাব :

লাহোর প্রস্তাবের অনেক আগেই ১৯৩০ খ্রিঃ কবি আল-মা ইকবাল মুসলমানদের জন্য আলাদা রাষ্ট্রের কথা উল্লেখাখ করেছেন। ১৯৩৩ খ্রিঃ কেম্ব্রিজ বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র চৌধুরী রহমত আলী ভারতের উত্তর-পশ্চিম অঞ্চলের সংখ্যাগরিষ্ঠ মুসলিম এলাকাগুলো নিয়ে পাকিস্তান নামক একটি রাষ্ট্রের রূপরেখা অঙ্কন করেন। ১৯৩৭-৩৮ খ্রিঃ পর্যন্ত মোহাম্মদ আলী জিন্নাহ মুসলমানদের জন্য পৃথক রাষ্ট্রের কথা ভাবেননি। কিন্তু ১৯৩৭ খ্রিঃ নির্বাচনের তিক্ত অভিজ্ঞতা এবং নির্বাচনের পরে বিজয়ী কংগ্রেস সভাপতির বক্তব্যে তিনি বুঝতে পারেন যে সংখ্যালঘু মুসলিম সমপ্রদায়ে আশা-আকাঙ্ক্ষা হিন্দু নেতৃবৃন্দের শাসনাধীনে বাস্তব রূপ লাভ করবে না। সার্বিক রাজনৈতিক পরিস্থিতি, অতীতের তিক্ত অভিজ্ঞতা এবং মুসলমানদের স্বার্থের কথা বিবেচনা করে ১৯৩৯ খ্রিঃ জিন্নাহ তাঁর বহু আলোচিত-সমালোচিত দ্বি-জাতি তত্ত্বের ঘোষণা দেন। ১৯৪০ খ্রিঃ লাহোর প্রস্তাব মূলত তার এই ঘোষণার বাস্তব রূপ দেওয়ার পথনির্দেশ করে।

১৯৪০ খ্রিঃ ২৩ মার্চ মুসলিম লীগের লাহোর অধিবেশনে এই প্রস্তাবটি গৃহীত হয় বলে এটি ইতিহাসে লাহোর প্রস্তাব নামে খ্যাত। উপমহাদেশের মুসলমানদের রাজনৈতিক ইতিহাসে লাহোর প্রস্তাব অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ ঘটনা। মুহাম্মদ আলী জিন্নাহ ছিলেন এই অধিবেশনের সভাপতি। এ কে ফজলুল হক ২৩ মার্চের অধিবেশনে তাঁর রচিত প্রস্তাবটি উত্থাপন করেন। লাহোর প্রস্তাবে বলা হয়, কোনো শাসনতান্ত্রিক পরিকল্পনা এদেশে কার্যকর হবে না, যদি এটি লাহোর প্রস্তাবে উত্থাপিত মূলনীতির উপর প্রতিষ্ঠিত না হয়।

লাহোর প্রস্তাবের প্রধান ধারাসমূহ-

ক. ভারতের উত্তর-পশ্চিম এবং পূর্ব ভূ-ভাগের মুসলমান সংখ্যাগরিষ্ঠ অঞ্চলগুলোকে নিয়ে স্বাধীন রাষ্ট্রসমূহ গঠন করতে হবে।

খ. এসব স্বাধীন রাষ্ট্রের সংশি- অঙ্গ রাষ্ট্রগুলো স্বায়ত্তশাসিত ও সার্বভৌম হবে।ষ্ট

গ. সংখ্যালঘু সমপ্রদায়গুলোর সাথে পরামর্শ করে তাদের সব অধিকার এবং স্বার্থরক্ষার জন্য সংবিধানে পর্যাপ্ত ব্যবস্থা রাখতে হবে।

ঘ. প্রতিরক্ষা, পররাষ্ট্র, যোগাযোগ ইত্যাদি বিষয়ে ক্ষমতা সংশি- অঙ্গ রাজ্যগুলোর হাতে ন্যস্ত থাকবে।ষ্ট

উল্লেখখত প্রস্তাবের ধারাসমূহের কোথাও পাকিস্তান শব্দটির উল্লেখ নেই। কিন্তু তৎকালীন বিভিন্ন পত্রপত্রিকায়খি এটিকে পাকিস্তান প্রস্তাব বলে প্রচার হতে থাকে। ফলে, দ্রুত এ প্রস্তাব ‘পাকিস্তান প্রস্তাব’ হিসেবে পরিচিতি লাভ করতে থাকে।

লাহোর প্রস্তাবে সংখ্যাগরিষ্ঠ মুসলিম অঞ্চলগুলো নিয়ে রাষ্ট্রসমূহ গঠন করার কথা বলা হয়েছিল। যার ফলে বাঙালি মুসলমান পূর্বাংশ নিয়ে একটি ‘স্বাধীন বাংলা রাষ্ট্র’ প্রতিষ্ঠার স্বপ্ন দেখেছিল। কিন্তু ১৯৪৬ খ্রিঃ ৯ এপ্রিল দিল্লিত মুসলিম লীগের দলীয় আইনসভার সদস্যদের এক কনভেনশনে নীতিবহির্ভূতভাবে জিন্নাহ ‘লাহোর প্রস্তাব’ সংশোধনের নামে ভিন্ন একটি প্রস্তাব উত্থাপন করেন। এতে মুসলিম সংখ্যাগরিষ্ঠ অঞ্চলসমূহ নিয়ে একটি রাষ্ট্র গঠনের কথা বলা হয়। সুতরাং, বলা যেতে পারে যে ১৯৪০ খ্রিঃ লাহোর প্রস্তাবের ভিত্তিতে নয়, ১৯৪৬ খ্রিঃ এপ্রিল মাসে উত্থাপিত দিল্লি প্রস্তাবের ভিত্তিতে পাকিস্তানের জন্ম হয়।

লাহোর প্রস্তাবের গুরুত্ব

লাহোর প্রস্তাবের প্রতি কংগ্রেস নেতাদের মধ্যে তীব্র প্রতিক্রিয়া সৃষ্টি হয়। পণ্ডিত জওহরলাল নেহরু এই প্রস্তাবের তীব্র নিন্দা করেন এবং মুসলমানদের জন্য স্বাধীন স্বতন্ত্র আবাসভূমি অসম্ভব বলে উল্লেখ করেন। তবে ঐতিহাসিক সত্য এইখ যে লাহোর প্রস্তাবের পর থেকে মুসলমান সমপ্রদায় নিজস্ব আলাদা রাষ্ট্রের স্বপ্ন দেখতে থাকে। এই প্রস্তাবের পরিপ্রেক্ষিতে ভারতের রাজনৈতিক-শাসনতান্ত্রিক আন্দোলনে এক নতুন ধারার জন্ম হয়। দ্বি-জাতি তত্ত্বের মাধ্যমে মোহাম্মদ আলী জিন্নাহ মুসলমানদের আলাদা জাতি হিসেবে চিহ্নিত করতে থাকেন। সে অনুযায়ী মুসলমানদের জন্য ভিন্ন রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠা শুধু সময়ের ব্যাপার হয়ে দাঁড়ায়। এরপর থেকে মুসলিম লীগ এবং জিন্নাহর রাজনীতি স্বতন্ত্র রাষ্ট্র গঠন প্রক্রিয়ার দিকে ধাবিত হতে থাকে; যার শেষ পরিণতি ছিল ১৯৪৭ সালের আগস্ট মাসের দেশ বিভাগ। দ্বি-জাতি তত্ত্বের বাস্তব পরিণতিতে ১৪ আগস্ট পাকিস্তান এবং ১৫ আগস্ট ভারত নামে দুটি রাষ্ট্রের জন্ম হয়।

বিভাগ-পূর্ব বাংলার রাজনীতি (১৯৩৭-১৯৪৭)

১৯২৫ সালে চিত্তরঞ্জন দাসের মৃত্যু এবং ১৯২৬ সালে কলকাতায় দাঙ্গা হিন্দু-মুসলমান সম্পর্কের ক্ষেত্রে বিরূপ পরিস্থিতি সৃষ্টি করে। এ পরিস্থিতিতে মওলানা আকরম খাঁ ও তমিজউদ্দিন খান প্রমুখ মুসলিম নেতা কংগ্রেস ত্যাগ করেন।

১৯২৯ সালে প্রাদেশিক আইন পরিষদের নির্বাচনের পর ‘নিখিল বঙ্গ প্রজা সমিতি’ নামে একটি দল গঠনের সিদ্ধান্ত গৃহীত হয়। এ সমিতির প্রধান উদ্দেশ্য ছিল বাংলার কৃষকের অবস্থার উন্নতি সাধন করা। ফলে কৃষক আন্দোলন ও রাজনীতিতে নতুন ধারা প্রবর্তিত হয়। ১৯৩৫ সালে ময়মনসিংহে অনুষ্ঠিত প্রজা সমিতির সম্মেলনে এ.কে. ফজলুল হক নিখিল বঙ্গ প্রজা সমিতির সভাপতি নির্বাচিত হন।

পরবর্তী বছরে এর নতুন নামকরণ হয় ‘কৃষক প্রজা পার্টি’। কৃষক প্রজা পার্টি ছিল সম্পূর্ণভাবে পৃথক এবং প্রদেশ পর্যায়ে গঠিত বাংলার রাজনৈতিক সংগঠন। ১৯৩৭ সালে মার্চে অনুষ্ঠিত নির্বাচনে তীব্র প্রতিদ্বন্দ্বিতা হয় কৃষক প্রজা পার্টি ও মুসলিম লীগের মধ্যে। তবে কোনো দল এককভাবে সরকার গঠন করার যোগ্যতা অর্জনে ব্যর্থ হয়। ফলে মুসলিম লীগ ফজলুল হকের নেতৃত্বে সরকার গঠনের প্রস্তাব গ্রহণ করেন। ফজলুল হক মুখ্যমন্ত্রী নিযুক্ত হন এবং শিক্ষামন্ত্রির দায়িত্ব গ্রহণ করেন। এ সম্মিলিত মন্ত্রিসভা ছিল দুর্বল। ফলে কৃষক প্রজা পার্টি দুর্বল হয়ে পড়ে।

জিন্নাহর সাথে ফজলুল হকের মতবিরোধের কারণে ১৯৪১ সালে ফজলুল হক মুসলিম লীগ থেকে পদত্যাগ করেন। ফজলুল হকের প্রতি সংখ্যাগরিষ্ঠ সদস্যদের সমর্থন থাকায় ঐ সালের ডিসেম্বর মাসেই তিনি দ্বিতীয় মন্ত্রিসভা গঠন করেন। এ নতুন মন্ত্রিসভা ছিল বহুদলের সমাবেশ। এরূপ একটি মন্ত্রিসভা গঠনের মাধ্যমে ফজলুল হক বাংলার রাজনীতিতে এক নতুন ধারার সূচনা করেন। এই নতুন ধারা ছিল বাংলার হিন্দু-মুসলমানের মধ্যে সামপ্রদায়িক সমপ্রীতি প্রতিষ্ঠা করে রাজনৈতিক সমস্যা সমাধান করা। ফজলুল হকের দ্বিতীয় মন্ত্রিসভা ১৯৪১ সাল থেকে ১৯৪৩ সাল পর্যন্ত ক্ষমতাসীন ছিল। ১৯৪৩ সালে ভয়াবহ দুর্ভিক্ষ প্রতিরোধের জন্য প্রয়োজনীয় সমর্থন না পেয়ে ফজলুল হক পদত্যাগ করতে বাধ্য হন।

১৯৪৩ সালের ১৩ এপ্রিল দেশব্যাপী দুর্ভিক্ষের পটভূমিতে খাজা নাজিমুদ্দিন মন্ত্রিসভা গঠন করেন। সর্বনাশা এ দুর্ভিক্ষে বাংলার ৩০ লক্ষাধিক লোক মৃত্যুবরণ করে বলে ধারণা করা হয়। ১৯৪৫ সালে নাজিমুদ্দিন মন্ত্রিসভার পতন ঘটে।

১৯৪৬ সালের প্রাদেশিক নির্বাচন ও নেতৃত্বকে কেন্দ্র করে বাংলার মুসলিম লীগ দুটি উপদলে বিভক্ত হয়। শেষ পর্যন্ত সোহরাওয়ার্দী বাংলার মুসলিম লীগের নেতা নির্বাচিত হন। নির্বাচনে মুসলিম লীগ ১১৪ আসনে জয়লাভ করে। যা প্রকারান্তের পাকিস্তান দাবির প্রতি বাংলার মুসলমানদের সুস্পষ্ট সমর্থনের প্রতিফলন ঘটায়।

বাংলার রাজনৈতিক ইতিহাসে এ নির্বাচন ও নির্বাচনের ফল ছিল অত্যন্ত তাৎপর্যপূর্ণ। ১৯৪৬ সালে ২৪ এপ্রিল সোহরাওয়ার্দী একটি মন্ত্রিসভা গঠন করেন। প্রকৃত পক্ষে সোহরাওয়ার্দী মন্ত্রিসভার সময়কাল ছিল বাংলা ও ভারতের রাজনৈতিক ইতিহাসের ক্রান্তিলগ্ন। ব্রিটিশ শাসনের অবসান ও দেশ বিভাগের রাজনৈতিক পরিবেশে কলকাতার দাঙ্গা ও স্বাধীন অখণ্ড বাংলা রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার প্রচেষ্টা ও ভারত বিভাগ ছিল এ সময়ের গুরুত্বপূর্ণ ঘটনা।

অখণ্ড বাংলার উদ্যোগ

১৯৪৭ খ্রিঃ হিন্দু-মুসলমান সম্পর্ক এক রক্তক্ষয়ী দাঙ্গায় রূপ নেয়। এরকম চরম জটিল পরিস্থিতি মোকাবেলায় ব্যর্থ ব্রিটিশ সরকার ভারতীয়দের হাতে ক্ষমতা হস্তান্তরের ইচ্ছা ঘোষণা করে। ঠিক এই রকম পরিস্থিতিতে বাংলার তৎকালীন মুখ্যমন্ত্রী হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দী যুক্ত বাংলার প্রস্তাব উত্থাপন করেন। এ প্রস্তাবের পক্ষে দৃঢ় অবস্থান নেন শরৎচন্দ্র বসু। প্রস্তাবটি উপমহাদেশের ইতিহাস ‘বসু’-সোহরাওয়ার্দী প্রস্তাব নামে খ্যাত।

১৯৪৭ খ্রিঃ ২৭ এপ্রিল দিল্লিত অনুষ্ঠিত এক সাংবাদিক সম্মেলনে শহীদ েসোহরাওয়ার্দী তাঁর বক্তব্যে স্বাধীন সার্বভৌম অখণ্ড বাংলা রাষ্ট্র গঠনের বিষয়টি উত্থাপন করেন এবং এর পক্ষে জোরালো যুক্তি উপস্থাপন করেন। মুসলিম লীগ নেতা আবুল হাশিম বৃহত্তর বাংলা রাষ্ট্রের একটি রূপরেখা প্রণয়ন করেন। পরবর্তীকালে শরৎচন্দ্র বসু তাঁর এক প্রস্তাবে অখণ্ড বাংলাকে

একটি ‘সোস্যালিস্ট রিপাবলিক’ হিসেবে গড়ে তোলার আহ্বান জানান।

বসু- সোহরাওয়ার্দী চুক্তি

১৯৪৭ খ্রিঃ ২০ মে তারিখে কলকাতায় কংগ্রেস নেতা শরৎচন্দ্র বসুর বাসগৃহে অখণ্ড বাংলার পক্ষে এক সভা অনুষ্ঠিত হয়। সভায় আলোচনার মাধ্যমে স্বাধীন সার্বভৌম অখণ্ড বাংলা রাষ্ট্রের পক্ষে এক চুক্তি স্বাক্ষরিত হয়। বৃহত্তর বাংলা রাষ্ট্রের পক্ষে বসু-সোহরাওয়ার্দী চুক্তিটি স্বাক্ষর করেন মুসলিম লীগের পক্ষে আবুল হাশিম এবং কংগ্রেসের পক্ষে শরৎচন্দ্র বসু। সভায় উপস্থিত ছিলেন মুসলিম লীগের হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দী, আবুল হাশিম, ফজলুর রহমান, মোহাম্মাদ আলী, এ. এম মালিক প্রমুখ নেতৃবৃন্দ। অপরদিকে হিন্দু নেতাদের মধ্যে উপস্থিত ছিলেন শরৎচন্দ্র বসু, কিরণ শংকর রায় ও সত্যরঞ্জন বখশী। সভায় স্বাক্ষরিত চুক্তিটি সংক্ষিপ্ত আকারে নিচে উল্লেখ করা হলো? খ-

এক. বাংলা হবে স্বাধীন ও সার্বভৌম রাষ্ট্র। ভারতের বাকি অংশের সঙ্গে ও রাষ্ট্রের সম্পর্ক কী হবে? তা সে নিজেই ঠিক করবে।

দুই. হিন্দু ও মুসলমানের সংখ্যা অনুপাতে আসনসংখ্যা বণ্টন করে প্রাপ্তবয়স্কদের ভোটাধিকারের ভিত্তিতে আইন সভায় নির্বাচনের ব্যবস্থা থাকবে।

তিন. স্বাধীন বাংলা প্রস্তাব গৃহীত হলে বাংলার বর্তমান মন্ত্রিসভা ভেঙে দেয়া হবে। পরিবর্তে অন্তর্বর্তীকালীন মন্ত্রিসভা গঠন করা হবে। উক্ত মন্ত্রিসভায় প্রধানমন্ত্রীর পদ ছাড়া বাকি সদস্যপদ হিন্দু ও মুসলমান সমপ্রদায়ের মধ্যে সমানভাবে বণ্টন করা হবে।

চার. সামরিক ও পুলিশ বাহিনীসহ সকল চাকরিতে হিন্দু ও মুসলমানের সংখ্যা সমান থাকবে। এসব চাকরিতে শুধু বাঙালিদের নিয়োগ দেয়া হবে।

পাঁচ. সংবিধান প্রণয়নের জন্য ৩০ সদস্যবিশিষ্ট গণপরিষদ থাকবে। এর মধ্যে ১৬ জন মুসলমান ও ১৪ জন হিন্দু সদস্য থাকবেন।

অখণ্ড বাংলা প্রস্তাবের ব্যর্থতা

অখণ্ড বাংলা প্রস্তাব নিয়ে কংগ্রেস-মুসলিম লীগ উভয় দলের নেতাদের মধ্যে তীব্র প্রতিক্রিয়ার সৃষ্টি করে। প্রথম দিকে মুসলিম লীগের গোঁড়াপন্থী রক্ষণশীল নেতারা বৃহত্তর স্বাধীন বাংলা রাষ্ট্রের পক্ষে ছিলেন। প্রাথমিক পর্যায়ে মহাত্মা গান্ধী ও মোহাম্মদ আলী জিন্নাহরও এই প্রস্তাবের প্রতি মৌন সমর্থন ছিল। কিন্তু প্রস্তাবটি প্রকাশের সঙ্গে সঙ্গে কংগ্রেস ও মুসলিম লীগের প্রথম সারির নেতাদের তীব্র বিরোধিতার কারণে বিষয়টি জটিল হয়ে যায়। ফলে উভয় নেতা অখণ্ড বাংলা রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার বিষয়ে মত বদলে ফেলেন। মুসলিম লীগের রক্ষণশীল নেতারা প্রথম দিকে এর সমর্থক হলেও পরে তারা অখণ্ড বাংলাকে পাকিস্তানের অংশ করার দাবি করতে থাকেন। বিশেষ করে খাজা নাজিমুদ্দিন, আকরম খাঁ প্রমুখ। আকরম খাঁ ১৬ মে দিল্লিত জিন্নাহর সঙ্গে এক বৈঠকের পর সাংবাদিকদের জানান যে অখণ্ড বাংলা মুসলিম-ে লীগ সমর্থন করে না। ফলে বসু-সোহরাওয়ার্দী প্রস্তাব মুসলিম লীগের সমর্থন হারায়।

বৃহত্তর স্বাধীন বাংলা রাষ্ট্র গঠনের প্রস্তাব অর্থাৎ বসু-সোহরাওয়ার্দী প্রস্তাব প্রথম থেকেই কংগ্রেসের উঁচু পর্যায়ের নেতাদের তীব্র বিরোধিতার মুখোমুখি হয়। কংগ্রেস নেতা জওহরলাল নেহরু ও সরদার বল- ভাই প্যাটেলসহ বহু নেতাভ- এর বিরোধী ছিলেন। তাঁরা কোনোমতেই স্বাধীন ভারতবর্ষে কলকাতাকে হাতছাড়া করার পক্ষপাতি ছিলেন না। তাছাড়া পেট্রোল ও অন্যান্য খনিজ সম্পদে সমৃদ্ধ আসামও তাঁদের প্রয়োজন ছিল। অপরদিকে কংগ্রেস মুসলমান সংখ্যাগরিষ্ঠ অখণ্ড বাংলায় হিন্দু সমপ্রদায়ে নিরাপত্তা নিয়েও শংকিত ছিলেন। হিন্দু মহাসভার শ্যামাপ্রসাদ যুক্ত বাংলার চরম বিরোধী ছিলেন। ফলে যুক্ত বাংলা প্রস্তাব কংগ্রেসের সমর্থন হারায়।

তাছাড়া বিভিন্ন পত্রপত্রিকা যুক্ত বাংলার বিরুদ্ধে ক্রমাগত প্রচারণা চালাতে থাকে। পশ্চিম বাংলাকেন্দ্রিক বাঙালি অবাঙালি, ব্যবসায়ী, বণিক, পুঁজিপতিশ্রেণি এর বিরুদ্ধে দৃঢ় অবস্থান গ্রহণ করে। এমনকি ঢাকার হিন্দু সমপ্রদায়ের বুদ্ধিজীবী শ্রেণিও যুক্ত বাংলার বিপক্ষে সোচ্চার ছিলেন। এই রকম পরিস্থিতিতে কংগ্রেসের কেন্দ্রীয় নেতৃত্ব স্বাধীন বাংলা পরিকল্পনা প্রত্যাখ্যান করে। অবস্থার পরিপ্রেক্ষিতে বাংলা কংগ্রেসের কার্যকরী কমিটিও সংখ্যাগরিষ্ঠ ভোটে বাংলা ভাগের পক্ষে প্রস্তাব গ্রহণ করে। অপরদিকে জুন মাসের ৩ তারিখে লর্ড মাউন্টব্যাটন ভারত বিভক্তির ঘোষণায় বাংলা ও পাঞ্জাব ভাগের পরিকল্পনা করেন। জুন মাসের ২০ তারিখে বিধান সভার সংখ্যাগরিষ্ঠ সদস্য বাংলা ভাগের পক্ষে রায় দিলে বাংলা বিভাগ অনিবার্য হয়ে পড়ে। ১৯৪৭ সালের ভারত স্বাধীনতা আইনে পাঞ্জাব ও বাংলা ভাগের কথা বলা হয়। ১৯৪৭ খ্রিঃ আইন অনুসারে ভারত ভাগ হয়। ১৪ আগস্ট জন্ম নেয় পাকিস্তান নামে এক কৃত্রিম মুসলিম রাষ্ট্রের; আর ১৫ আগস্ট জন্ম নেয় আরেকটি রাষ্ট্রের, যার নাম হয় ভারত। পূর্ব বাংলা পাকিস্তানের অংশে পরিণত হয়- পরবর্তীকালে যা পূর্ব পাকিস্তান নামে পরিচিতি লাভ করে। অপরদিকে পশ্চিম বাংলা যুক্ত হয় ভারতের সঙ্গে। এভাবেই প্রস্তাবিত অখণ্ড স্বাধীন বাংলা রাষ্ট্র গঠনের স্বপ্ন ব্যর্থ হয়ে যায়।

বৃটিশ শাসন অবসান

ভারত ও পাকিস্তানের অভ্যূদয়

বৃটিশ শাসন অবসানের পূর্ব কথা : ১৯৪২ খ্রিঃ ক্রিপস মিশন প্রস্তাব সব মহল প্রত্যাখ্যান করলে সমগ্র ভারতব্যাপী তীব্র অসন্তোষ দেখা দেয়। রাজনীতিতেও নেমে আসে চরম হতাশা। উপমহাদেশের বাইরে এ সময় পৃথিবীব্যাপী চলছে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের ধ্বংসযজ্ঞ। জার্মানির মিত্র রাষ্ট্র জাপানের ভারত আক্রমণ আশঙ্কায় ভারতীয়দের মনে আতঙ্কের সৃষ্টি হয়। গান্ধীজি ভারতে ব্রিটিশ সরকারের উপস্থিতিকে এই আক্রমণের কারণ হিসেবে চিহ্নিত করেন। সুতরাং, ব্রিটিশ সরকার ভারত ছাড়লে জাপানের ভারত আক্রমণ পরিকল্পনার পরিবর্তন হতে পারে। এই চিন্তা করে এলাহাবাদে অনুষ্ঠিত সম্মেলনে তাঁর প্রেরিত প্রস্তাবে তিনি ইংরেজদের ভারত ছেড়ে যেতে বলেন। শুরু হয় কংগ্রেসের ভারত ছাড় আন্দোলন। গান্ধীজির ডাকে ‘ভারত ছাড়’ আন্দোলনে জনগণ ঝাঁপিয়ে পড়ে। সারা ভারতব্যাপী আন্দোলন ছড়িয়ে পড়ে এবং প্রবল ব্রিটিশবিরোধী রূপ নেয়। ১৯৪২ খ্রিঃ ৮ আগস্ট বোম্বাইয়ে অনুষ্ঠিত নিখিল ভারত কংগ্রেস কমিটির ঐতিহাসিক অধিবেশে মহাত্মা গান্ধী এক ঘোষণায় বলেন ‘আমি অবিলম্বে স্বাধীনতা চাই। এমনকি এই রাত্রির মধ্যেই, উষালগ্নের আগেই যদি তা সম্ভব হয়।’ তিনি আরো বলেন, আমরা লড়াই করে স্বাধীনতা অর্জন করব। আর এ হবে আমাদের জীবনে শেষ লড়াই।

কিন্তু ইংরেজ সরকার ঐ সময় কোনোভাবেই ভারতীয়দের হাতে ক্ষমতা ছেড়ে দিতে প্রস্তুত ছিল না। বরং সরকার এই আন্দোলন দমন করার দৃঢ়প্রতিজ্ঞা গ্রহণ করে। ঐ দিনই মধ্যরাতে কংগ্রেসের শীর্ষস্থানীয় নেতৃবৃন্দ গান্ধীজি, আবুল কালাম আজাদ, জওহরলাল নেহরুসহ অনেকে গ্রেফতার হন। সরকার কংগ্রেসকে বেআইনি ঘোষণা করে এবং এক সপ্তাহের মধ্যে প্রায় সব নেতা কারাগারে বন্দী হন।

নেতৃবন্দের গ্রেফতারের খবরে অহিংস আন্দোলন সংহিস আন্দোলনে পরিণত হয়। নেতাদের মুক্তির দাবিতে সর্বত্র হরতাল, কলকারখানা, স্কুল-কলেজে ধর্মঘট পালিত হতে থাকে। উত্তেজিত জনতা স্থানে স্থানে রেললাইন উপড়ে ফেলা, চলন্ত ট্রেনে ইট পাটকেল নিক্ষেপ, রেল স্টেশনে, সরকারি ঘর-বাড়িতে আগুন ধরিয়ে দেওয়ার মতো বেপরোয়া হয়ে উঠে। নেতৃত্বহীন আন্দোলন জনগণের স্বতঃস্ফূর্ত অংশগ্রহণে সারা ভারতে নিয়ন্ত্রণহীনভাবে অগ্রসর হতে থাকে। কোথাও কোথাও অস্থায়ী সরকার, কোথাও বা জাতীয় সরকার গঠন করা হয়। ভয়াবহ ঘটনা ঘটে তমলুক থানা দখল করার সময়, মাতঙ্গিনী হাজরা নামে এক বৃদ্ধা পুলিশের গুলি সত্ত্বেও জাতীয় পতাকা দৃঢ়মুষ্ঠিতে ধরে রেখে শহিদ হন।

এই আন্দোলনের পর পর ১৯৪৩ সালে সৃষ্ট কৃত্রিম দুর্ভিক্ষ মানুষকে দিশেহারা করে তোলে। তাছাড়া দেশব্যাপী মারাত্মক মুদ্রাস্ফীতি, দুর্নীতি, দ্রব্যমূল্যের ঊর্ধ্বগতি সব মিলে মানুষের অর্থনৈতিক অবস্থা বিপর্যস্ত হয়ে পড়ে। ফলে হতাশ জনগণের মধ্যে ব্রিটিশবিরোধী মনোভাব তীব্র হতে থাকে।

যখন দেশের অভ্যন্তরে রাজনীতিতে চরম হতাশা বিরাজ করছে, ব্যর্থ হয়েছে ইংরেজ তাড়ানোর প্রাণপণ প্রচেষ্টা, তখন যুদ্ধ করে ইংরেজ বিতাড়নের জন্য বাঙালিদের নেতৃত্বে দেশের বাইরে গঠিত হয় আজাদ হিন্দ ফৌজ বা ওহফরধহ ঘধঃরড়হধষ অৎসু (ওঘঅ)। এই সেনাবাহিনীর নেতৃত্বে ছিলেন নেতাজি সুভাষচন্দ্র বসু। এই বাহিনী গড়তে সাহায্য করেন আরেক বাঙালি বিপ্লবী রাসবিহারী বসু। কংগ্রেসের প্রাক্তন সভাপতি ফরওয়ার্ড ব-কর প্রতিষ্ঠাতা সুভাষ বসু কংগ্রেসেব–ে আপসকামী রাজনীতির বিপক্ষে ছিলেন। প্রথম থেকেই স্বাধীনতা অর্জনের পদ্ধতির প্রশ্নে গান্ধীজির সঙ্গে মতানৈক্য ছিল। কিশোর বয়স থেকে বিপ্লবী মনোভাবাপন্ন সুভাষ বসু ছিলেন গান্ধীর অহিংস নীতির বিরোধী। ১৯৩৭ খ্রিঃ গান্ধীরব- অনুমোদনে কংগ্রেসের সভাপতি হলেও গান্ধীই আবার দ্বিতীয় দফায় তাঁকে সভাপতি পদে মনোনয়ন দেননি। তিনি সুভাষ বসুকে এ পদে নির্বাচন করতে নিষেধ করেন। সুভাষ বসু এই নিষেধাজ্ঞা অগ্রাহ্য করেন এবং গান্ধীর মনোনীত প্রার্থীকে হারিয়ে আবার সভাপতি নির্বাচিত হন। গান্ধীর প্রতি এই ধরনের চ্যালেঞ্জে জয়ী সুভাষ পরবর্তীতে কংগ্রেসের রাজনীতিতে গান্ধীর সহযোগিতা পেতে ব্যর্থ হন। হতাশ হয়ে সুভাষ বসু কংগ্রেস ছেড়ে ফরওয়ার্ড ব- দল গঠন করেন। তাঁর রাজনীতিক আপসহীন পথে অগ্রসর হতে থাকে। সুভাষ বসুর রাজনৈতিক কর্মকাণ্ডে ভীত ইংরেজ সরকার বারবার তাঁকে কারারুদ্ধ করে। শেষ পর্যন্ত কারামুক্তি লাভ করে ১৯৪১ খ্রিঃ সবার অলক্ষে সুভাষ বসু দেশ ত্যাগ করেন। তখন দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ চলছে। তিনি প্রথম ইংরেজদের শত্রু ভূমি জার্মানিতে গমন করেন। সেখানে ভারতের স্বাধীনতার জন্য জার্মান সরকারের সঙ্গে যোগাযোগ এবং সেনাবাহিনী গঠনের চেষ্টা করেন। তিনিই প্রথম ভারতীয় রাজনীতিবিদ, যিনি বিদেশি শক্তির সাহায্য নিয়ে লড়াই করে মাতৃভূমি স্বাধীন করতে চেয়েছিলেন। পরিস্থিতি অনুকূলে না থাকায় ডুবোজাহাজে করে এক দুঃসাহসিক অভিযানের মাধ্যমে আটলান্টিক ও ভারত মহাসাগর পাড়ি দিয়ে তিনি জাপানে আসেন। সেখানে অবস্থানরত বিপ্লবীব- রাসবিহারী বসুর সহযোগিতায় গড়ে তোলেন জাপানে বন্দী ভারতীয় সেনাদের নিয়ে আজাদ হিন্দু ফৌজ। ১৯৪৩ খ্রিঃ তিনি এই বাহিনীর নেতৃত্ব গ্রহণ করেন এবং ঐ বছরই ভারতীয় ভূখণ্ডের আন্দামান দ্বীপে গঠন করেন আজাদ হিন্দ সরকার বা স্বাধীন ভারত সরকার। ১৯৪৫ খ্রিঃ পর্যন্ত এই সরকারের সেনাবাহিনী বিভিন্ন রণাঙ্গনে ইংরেজদের বিরুদ্ধে বিরত্বের সঙ্গে লড়াই করে। আজাদ হিন্দু ফৌজ এবং সুভাষ বসু তখন ছিল ইংরেজদের কাছে আতঙ্ক। সুভাষ বসুর ইংরেজদের বিরুদ্ধে সশস্ত্র সংগ্রাম ভারতে ইংরেজ সরকারের ভিত কাঁপিয়ে দেয়। এই দুঃসাহসী বাঙালি নেতার নেতৃত্বে আজাদ হিন্দ ফৌজ ১৯৪৪ খ্রিঃ বার্মা হয়ে ভারত ভূমিতে পদার্পণ করে। কোহিমা-ইম্ফলের রণাঙ্গনে বীরত্ব ও সাফল্যের সঙ্গে লড়াই করে আজাদ হিন্দু ফৌজ এসব অঞ্চল দখল করে নেয়। দুর্ভাগ্যক্রমে এই রণাঙ্গনে জাপানী বাহিনী ইংরেজ বাহিনীর তীব্র আক্রমণ মোকাবেলা করতে ব্যর্থ হয়ে পিছু হটলে আজাদ হিন্দ ফৌজকেও পিছু হটতে হয়। ১৯৪৫ খ্রিঃ জাপানের রেঙ্গুন ত্যাগ, মিত্রবাহিনীর বিজয়ে আজাদ হিন্দ ফৌজের অগ্রযাত্রা ব্যাহত হয়। ব্যর্থ হয় এক দুঃসাহসী বাঙালি দেশপ্রেমিকের লড়াই করে মাতৃভূমির স্বাধীনতা উদ্ধারের প্রচেষ্টা। নেতাজি সুভাষ বসু সফল হলে ভিন্নভাবে লিখতে হতো ভারতের স্বাধীনতা সংগ্রামের ইতিহাস। তখনি রচিত হতো বাঙালির দেশপ্রেম আর বিরত্বের আরেক গৌরবের ইতিহাস।

সুভাষ বসু প্রতিষ্ঠিত আজাদ হিন্দ সরকার ছিল অসামপ্রদায়িক। এই সরকার ও সেনাবাহিনীতে অনেক যোগ্য অফিসার এবং সেনাসদস্য ছিল, যারা ছিলেন মুসলমান। তাঁর অত্যন্ত বিশ্বস্ত সেনাপ্রধান শাহনাওয়াজ ছিলেন মুসলমান। এই অসাম্প্রদায়িক চেতনাসমৃদ্ধ প্রগতিশীল বাঙালি নেতা নেতাজি সুভাষ বসু দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর নিরুদ্দেশ হয়ে যান। তাঁর অন্তর্ধান সম্পর্কে নানা কাহিনী প্রচলিত থাকলেও প্রকৃত সত্য এখনও গবেষণার বিষয়। নেতাজির অভিযান ব্যর্থ হলেও তাঁর অভিযান ভারতীয় স্বাধীনতাকামী জনগণের মধ্যে আত্মবিশ্বাস ও সাহসের সঞ্চার করেছিল। তিনি ব্রিটিশ ভারতে

দেশীয় সেনাসদস্যদের মধ্যে আনুগত্যের ফাটল ধরাতে যেমন সক্ষম হয়েছিলেন, তেমনি তাদের বিদেশি শাসনের বিরুদ্ধে বিদ্রোহে প্রেরণা যুগিয়েছিলেন।

আজাদ হিন্দ ফৌজের ব্যর্থতার পর ১৯৪৬ খ্রিঃ বোম্বাইয়ে নৌ-বিদ্রোহ দেখা দেয়। এসব আলামত প্রমাণ করে যে ব্রিটিশ সরকারের পক্ষে ভারতীয়দের আয়ত্তে রাখা ক্রমশ অসম্ভব হয়ে পড়ছে। এই পরিস্থিতি মোকাবেলার জন্য ব্রিটিশ সরকার একের পর এক উদ্যোগ গ্রহণ করতে থাকে। ইতোপূর্বে যুদ্ধ চলাকালীন সমস্যা সমাধানের প্রচেষ্টা নেয়া হয়েছিল। এই উদ্দেশে ১৯৪৫ খ্রিঃ সিমলায় ভারতীয় নেতৃবৃন্দের উপস্থিতিতে ভারতের গভর্নর জেনারেল লর্ড ওয়াভেল এক পরিকল্পনা পেশ করেন, যা ‘ওয়াভেল পরিকল্পনা’ নামে পরিচিত। কংগ্রেস-মুসলিম লীগের মধ্যে অন্তর্বর্তী সরকারের সামপ্রদায়ভিত্তিক প্রতিনিধির সংখ্যা নিয়ে তীব্র মতবিরোধের কারণে ‘ওয়াভেল পরিকল্পনা’ ব্যর্থ হয়।

দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ অবসানের পর ইংল্যান্ডের সাধারণ নির্বাচনে শ্রমিক দল জয়লাভ করে। এই পরিবর্তনের ধারা ভারতের রাজনীতিতেও প্রভাব ফেলে। শ্রমিক দল ভারতের স্বাধীনতা দানের এবং ভারতীয়দের আত্মনিয়ন্ত্রণ অধিকারের প্রতি সহানুভূতিশীল ছিল। এ উদ্দেশ্যকে সামনে রেখে ইংল্যান্ডের নতুন প্রধানমন্ত্রী অ্যাটলি ১৯৪৬ খ্রিঃ ভারতে সাধারণ নির্বাচনের কথা ঘোষণা করেন। সাধারণ নির্বাচন সামনে রেখে নেতৃত্বে দ্বন্দ্বের ফলে প্রাদেশিক মুসলিম লীগ দুটি উপদলে বিভক্ত হয়ে যায়। খাজা নাজিমুদ্দিন ছিলেন অবাঙালি ব্যবসায়ী ও রক্ষণশীলদের নেতা। অপরদিকে আবুল হাশিম এবং হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দী ছিলেন প্রগতিশীল বাঙালিদের নেতৃত্বে। শেষ পর্যন্ত সোহরাওয়ার্দীই বাংলার মুসলিম লীগের নেতা নির্বাচিত হন। এই নির্বাচনে মুসলমান তরুণ ছাত্রসমাজ মুসলিম লীগকে সমর্থন দেয়। পাকিস্তান প্রতিষ্ঠার দাবিকে প্রধান নির্বাচনী কর্মসূচি করে মুসলিম লীগ প্রাদেশিক আইন সভায় অভূতপূর্ব বিজয় অর্জন করে। এই নির্বাচন এদেশের রাজনৈতিক ইতিহাসে অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। কারণ এ নির্বাচনের মাধ্যমে বাংলার মুসলমানদের পাকিস্তান প্রতিষ্ঠার পক্ষে সুস্পষ্ট রায় ঘোষিত হয় এবং মুসলিম লীগ নিজেকে বাংলার মুসলমানদের প্রতিনিধিত্বকারী একমাত্র দল হিসেবে প্রমাণ করতে সক্ষম হয়। উল্লেখ্য, বর্তমান পাকিস্তান অংশে এই নির্বাচনে মুসলিম লীগ গরিষ্ঠ ভোট পায়নি।খ অর্থাৎ বাঙালি মুসলমানের ভোটে পাকিস্তান প্রস্তাব জয়ী হয়েছিল। এই জয়ের পেছনে প্রধান ভূমিকা রেখেছিলেন হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দী ও বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান।

নির্বাচন-উত্তর উপমহাদেশের রাজনীতিতে ভিন্ন পরিস্থিতির উদ্ভবের সম্ভাবনা দেখা দেয়। বিচক্ষণ অ্যাটলি সরকার বুঝতে পারেন যে সম্মানজনকভাবে খুব বেশি দিন ব্রিটেনের পক্ষে ভারত শাসন করা সম্ভব হবে না। ফলে ১৯৪৬ খ্রিঃ ভারত সচিব প্যাথিক লরেন্সের নেতৃত্বে এক প্রতিনিধিদল ভারতে আসে। যাকে বলা হয় ক্যাবিনেট মিশন। এ সময় দিল্লিত অনুষ্ঠিত মুসলিম লীগের কনভেনশন পাকিস্তান দাবি মেনে নিয়ে রাজনৈতিক সংকট সমাধানের জন্য ক্যাবিনেট মিশনের প্রতি আহ্বান জানায়। কংগ্রেস ও মুসলিম লীগ নেতৃবৃন্দের সঙ্গে আলাপ-আলোচনার মাধ্যমে ক্যাবিনেট মিশন মে মাসে ভারতের ভবিষ্যৎ সংবিধান সম্পর্কিত সুনির্দিষ্ট প্রস্তাব পেশ করে।

মন্ত্রীমিশন বা ক্যাবিনেট মিশন প্রস্তাবিত পরিকল্পনায় তিন স্তরবিশিষ্ট যুক্তরাষ্ট্র গঠনের বিষয় উল্লেখ করা হয়। যথা-খ

ক. কেন্দ্রে একটি অন্তর্বর্তীকালীন সরকার গঠন করা।

খ. ব্রিটিশ ভারত ও দেশীয় রাজ্যগুলোকে নিয়ে একটি স্বায়ত্তশাসিত ভারত ইউনিয়ন গঠন করা।

গ. হিন্দুপ্রধান গ্রুপ, মুসলমানপ্রধান গ্রুপ এবং বাংলা ও আসাম গ্রুপ- এ তিন ভাগে প্রদেশগুলোকে ভাগ করা এবং প্রত্যেক গ্রুপের জন্য একটি গণপরিষদ গঠন করা। তবে শর্ত দেওয়া হয় যে এ পরিকল্পনা গ্রহণ করলে সার্বিকভাবে করতে হবে। এর অংশবিশেষ গ্রহণ করা যাবে না।

মন্ত্রী মিশন পরিকল্পনায় পাকিস্তান দাবি অগ্রাহ্য হলেও মুসলিম লীগ পরিকল্পনাটি গ্রহণ করে। কারণ মুসলিম লীগ মনে করে যে পরিকল্পনার মধ্যে পাকিস্তান প্রতিষ্ঠার সম্ভাবনা নিহিত আছে। কংগ্রেস এ পরিকল্পনায় এককেন্দ্রিক সরকার গঠনের মধ্যে অখণ্ড ভারত গঠন দাবির প্রতিফলন দেখতে পায়। কংগ্রেস নিজস্ব ব্যাখ্যা অনুযায়ী প্রস্তাবটি গ্রহণে রাজি ছিল। কিন্তু শেষ পর্যন্ত কংগ্রেস মন্ত্রিমিশন পরিকল্পনা প্রত্যাখ্যান করলে মুসলিম লীগও তা প্রত্যাখ্যান করে। ফলে রাজনৈতিক সংকট সমাধানে মন্ত্রী মিশন পরিকল্পনার প্রস্তাবগুলো অকেজো হয়ে যায়।

বড়লাট ওয়েভেল মুসলিম লীগ ও কংগ্রেস দলকে অন্তর্বর্তীকালীন সরকারে যোগদানের আহ্বান জানান। কংগ্রেসের নবনির্বাচিত সভাপতি নেহরুর মুসলিম লীগের স্বার্থবিরোধী বক্তব্যের পরিপ্রেক্ষিতে মুসলিম লীগ সরকারে যোগদানের পূর্ব সিদ্ধান্ত বাতিল করে। কিন্তু বড়লাটের আহ্বানে নেহরু সরকার গঠনে উদ্যোগ গ্রহণ করে। এর প্রতিবাদে মুসলিম লীগ ১৬ আগস্ট ‘প্রত্যক্ষ সংগ্রাম দিবস’ ঘোষণা করে। এই দিন ভয়াবহ দাঙ্গায় হাজার হাজার নিরীহ মানুষ নিহত হয়। সামপ্রদায়িক দাঙ্গা এবং হিন্দু-মুসলমান সম্পর্কের মারাত্মক অবনতি ঘটলে ব্রিটিশ সরকার ভারতীদের কাছে ক্ষমতা হস্তান্তরের কথা ঘোষণা করেন।

ব্রিটিশ প্রধানমন্ত্রী অ্যাটলি ১৯৪৭ খ্রিঃ ফেব্রুয়ারি মাসে ঘোষণা করেন যে ১৯৪৮ খ্রিঃ জুন মাসের পূর্বে ভারতীয়দের কাছে ক্ষমতা হস্তান্তর করা হবে। ক্ষমতা হস্তান্তরের দায়িত্ব পালনের জন্য লর্ড ওয়াভেল স্থলে লর্ড মাউন্টব্যাটেনকে ভারতের বড়লাট হিসেবে পাঠানো হয়।

লর্ড মাউন্টব্যাটেন কংগ্রেস ও মুসলিম লীগ নেতাদের সঙ্গে আলাপ-আলোচনার মাধ্যমে ভারত বিভক্তির সিদ্ধান্ত গ্রহণ করেন। সামপ্রদায়িক দাঙ্গা-হাঙ্গামা থেকে দেশরক্ষার জন্য শেষ পর্যন্ত নেতৃবৃন্দ দেশবিভাগে সম্মত হতে বাধ্য হন। ৩রা জুন মাউন্টব্যাটন সুস্পষ্টভাবেই ভারত বিভাগের পরিকল্পনা ঘোষণা করেন। তিনি এও ঘোষণা করেন যে, ১৯৪৮ খ্রিঃ পূর্বেই ভারতীয়দের হাতে ক্ষমতা অর্পণ করা হবে। অপরদিকে পাকিস্তান দাবি মেনে নেয়ায় মুসলিম লীগ সন্তোষ প্রকাশ করে।

১৯৪৭ খ্রিঃ ১৫ জুলাই লন্ডনে কমন্স সভার এক ঘোষণায় ভারত-পাকিস্তান নামে দুটি স্বাধীন ডোমিনিয়ন প্রতিষ্ঠার কথা বলা হয়। দুই দেশের সীমানা নির্ধারণের জন্য স্যার র‌্যাডক্লিফের নেতৃত্বে সীমানা নির্ধারণ কমিটি গঠন করা হয়। ৯ আগস্ট র‌্যাডক্লিফ তাঁর সীমান্ত রোয়েদাদ সমাপ্ত করে তা ভাইসরয়ের কাছে জমা দেন, যা রহস্যজনক কারণে আলোর মুখ দেখেনি। ১৯৪৭ খ্রিঃ ১৮ জুলাই ‘ভারত স্বাধীনতা আইন’ প্রণয়ন করা হয়, যার ভিত্তিতে ব্রিটিশ শাসনের অবসান ঘটে। ১৯৪৭ সালে ১৪ আগস্ট পাকিস্তান এবং ১৫ আগস্ট ভারত নামে দুটি রাষ্ট্রের জন্ম হয়।


পূর্ববঙ্গ ও আসাম (১৯০৫-১৯১১)  বহু শতাব্দীর রাজনৈতিক, সামাজিক, সাংস্কৃতিক, অর্থনৈতিক বিবর্তন ধারায় গঠিত বঙ্গ, বাংলা, বঙ্গদেশ বা বাংলাদেশকে বিভক্ত করে ১৯০৫ সালে পূর্ববঙ্গ ও আসাম নামে একটি নতুন প্রদেশ সৃষ্টি করা হয়। এর জন্য জনগণের পক্ষ থেকে কোন দাবি ছিল না। বঙ্গ বিভাগ ছিল বৃটিশ উপনিবেশিক শাসক শ্রেণির একটি কৌশলগত পদক্ষেপ। এ নীতির লক্ষ্য ছিল অপেক্ষাকৃত অনুন্নত পূর্ববঙ্গ ও আসামকে একটি একক ও অনুগত প্রদেশে রূপান্তরিত করা।

যে প্রেক্ষাপটে ১৯০৫ সালে বাংলাকে ভাগ করা হলো তা ছিল দ্রুত প্রসারমান জাতীয়তাবাদী চেতনাকে বাড়তে না দেয়া, অন্তত পূর্ব বঙ্গ ও আসাম অঞ্চল যেন কলকাতা ভিত্তিক রাজনৈতিক মধ্যবিত্ত শ্রেণির প্রভাব থেকে মুক্ত থাকে। ভৌগোলিক-রাজনৈতিক কারণে ভারতের পূর্বাঞ্চলকে ক্রম বর্ধমান জাতীয়তাবাদী আন্দোলন থেকে মুক্ত রাখা ছিল শাসক শ্রেণির পক্ষে একটি সামরিক ও রাজনৈতিক প্রয়োজন। ভারত সরকার এ প্রয়োজন বোধ করে সমকালীন জাপান, চীন ও দক্ষিণ পূর্ব এশিয়ার ঘটনা প্রবাহ থেকে।

বঙ্গ বিভাগের পক্ষে এ অঞ্চলের জন সমর্থন লাভের উদ্দেশ্যে উন্নয়নমূলক অনেক লোভনীয় নীতি ঘোষণা করা হয়। ব্যাপক প্রচার করা হয় যে, এ ব্যবস্থা নতুন প্রদেশের উন্নয়ন ও কল্যাণের পক্ষে সহায়ক হবে, এবং অনেকটা হয়েছিলও তাই। কিন্তু বঙ্গ বিভাগ বাংলার জাতীয়তাবাদী হিন্দু সম্প্রদায়কে ক্ষুব্ধ করে তোলে।

নতুন প্রদেশ সৃষ্টির আলোচনা শুরু থেকেই বাংলার হিন্দু জাতীয়তাবাদী গোষ্ঠী বঙ্গ বিভাগের বিরুদ্ধে আন্দোলন গড়ে তোলার চেষ্টা করে। ১৯০৫ সালে বঙ্গভঙ্গ প্রকল্প বাস্তবায়িত হলে এর বিরুদ্ধে কলকাতা ভিত্তিক আন্দোলন ক্রমশ জোরদার হতে থাকে। বঙ্গভঙ্গ বিরোধী আন্দোলনে মুসলমানদের অংশগ্রহণ ছিল নগন্য। পূর্ববঙ্গের সংখ্যাগরিষ্ঠ মুসলমান বৃটিশ শাসকগোষ্ঠীর দ্বারা উৎসাহিত হয়ে বঙ্গ বিভাগের পক্ষে মত প্রকাশ করে। কিন্তু তারা এর সমর্থনে তাদের রাজনৈতিক মত কখনো প্রবলভাবে প্রকাশ করতে পারেনি। এর প্রধান কারণ আপেক্ষিক পশ্চাদপদতার কারণে সাংগঠনিক দুর্বলতা। সে তুলনায় বাঙালি হিন্দু জাতীয়তাবাদী গোষ্ঠী বঙ্গবিভাগ রদের জন্য তুমুল চাপ সৃষ্টি করতে সক্ষম হয়। বঙ্গভঙ্গ বিরোধী আন্দোলনকে কেন্দ্র করে হিন্দু-মুসলমান সম্পর্কে অবনতি ঘটে। ১৯০৬ থেকে সাম্প্রদায়িক দাঙ্গা শুরু হয়। কুমিল্লা-ময়মনসিংহ, নোয়াখালী, পাবনা, ঢাকা প্রভৃতি অঞ্চলে সাম্প্রদায়িক দাঙ্গা ভয়াবহ রূপ ধারণ করে। তবে এসব দাঙ্গায় হতাহতের চেয়ে পারস্পরিক ভয়ভীতি ছিল অনেক বেশি।

নিয়ত জঙ্গি প্রতিবাদ সভা ও মিছিল, হরতাল, দাঙ্গা প্রভৃতি সমস্যা এবং এর সফল মোকাবেলায় মুসলমানদের দুর্বল সাংগঠনিক দুর্বলতা সরকারকে বঙ্গভঙ্গ ইস্যুটি পুনর্বিবেচনা করতে বাধ্য করে। ক্রমশ বাংলায় বিপ্লবী সন্ত্রাস আন্দোলন জোড়ালো হতে থাকে। এসবের নিরিখে শেষ পর্যন্ত বৃটিশ পার্লামেন্টের নির্দেশে ভারত সরকার পূর্ববঙ্গ ও আসাম প্রদেশ পূণরায় পূর্বাবস্থায় ফিরিয়ে আনার সিদ্ধান্ত নেয়। ভারত সরকারের সিদ্ধান্ত অনুসারে ১৯১১ সালের এপ্রিল মাস থেকে আসামকে পূর্বের মতো কমিশনারের অধীনে নেয়া হয়। বাংলা একত্রিত হবার প্রক্রিয়া শেষ হয় ১৯১২ সালের এপ্রিল মাসে।

নতুন পূর্ববঙ্গ ও আসাম প্রদেশ পরিকল্পনার একটি বিঘোষিত নীতি ছিল অর্থনৈতিকভাবে স্থবির ও অবহেলিত পূর্ববঙ্গকে উন্নয়নের মহাসড়কে সংযুক্ত করা। এর বিশেষ লক্ষ্য ছিল এ অঞ্চলের অপেক্ষাকৃত অনুন্নত মুসলমানদের অর্থনৈতিক উন্নয়ন ত্বরান্বিত করা। প্রকৃতপক্ষে তার প্রক্রিয়াও শুরু হয়েছিল। দেখা যায় যে, পাঁচ বছরের মধ্যেই পূর্ববঙ্গ এলাকায় অনেক উন্নয়নমূলক কর্মকান্ড বাস্তবায়িত হয়েছে। ব্যবসা ও যোগাযোগ ব্যবস্থায় অনেক পরিবর্তন আসে। ঢাকা, শিলং ও চট্টগ্রামকে সংযুক্ত করে রেল, সড়ক ও জলপথ সুগম করা হয়। বৈদেশিক বাণিজ্যে চট্টগ্রাম বন্দর বিশেষভাবে সচল হয়ে উঠে। বিদ্যমান রেলপথ ব্যবস্থা ছিল কলকাতামুখী। নতুন প্রদেশের জন্য বেশ কয়েকটি রেললাইন ও স্টিমার সার্ভিস স্থাপিত হয় যেগুলো চট্টগ্রাম, ঢাকা, বগুড়া, রংপুর, দিনাজপুর, জলপাইগুড়ি, রাজশাহী ও মালদহের সঙ্গে যোগাযোগ ত্বরান্বিত করে। এগুলির প্রতিফলন ঘটে পূর্ববঙ্গের সার্বিক অর্থনীতির ওপর। পার্বত্য চট্টগ্রামে অনেকগুলি মহাসড়ক তৈরির ফলে ঐ এলাকার দুর্গমতা দূর হয় এবং ব্যবসা বাণিজ্যের পথ সুগম হয়। পূর্ববঙ্গের প্রতিটি জেলায় এক শহর থেকে আরেক শহরে সংযোগকারী সড়ক নির্মাণ করা হয়। যার ফলে আন্তঃজেলা গমনাগমনে সময় ও দূরত্ব কমে আসে। সরকার স্থানীয় শিল্প বিকাশে প্রয়োজনীয় সহায়তা প্রদান করে। অচিরেই দেখা যায় যে, অনেক শিল্পে বিশেষ করে তাঁত শিল্পে পুঁজি বিনিয়োগের অনুকূল পরিবেশ সৃষ্টি হয়। পাবনা, বগুড়া, ঢাকা ও নোয়াখালীতে তাঁত শিল্পের বিকাশে যথেষ্ট পুঁজি বিনিয়োগের অনুকূল পরিবেশ সৃষ্টি হয়। তাঁত শিল্পের পাশাপাশি হুশিয়ারী শিল্পও বিকশিত হতে থাকে। বিভিন্ন জেলায়, বিশেষ করে ঢাকা ও পাবনা জেলায় সূতা রং করার শিল্পও বিকশিত হয়।

পূর্ববঙ্গ ও আসাম প্রদেশ গঠনের পর ঐতিহাসিক ঢাকায় আবার রাজধানী স্থাপন করায় নতুন নতুন সুযোগসুবিধা সৃষ্টি হয়। এর মধ্যে অন্যতম ছিল শিক্ষা বিস্তারের অবকাঠামো নির্মাণ। বৃটিশ শাসনের সৃষ্ট শিক্ষা ব্যবস্থার কেন্দ্রবিন্দু ছিল কলকাতা। ঢাকা ও পূর্ব বাংলায় শিক্ষার লক্ষণীয় বিস্তার ঘটেছে পূর্ববঙ্গ ও আসাম প্রদেশ প্রতিষ্ঠার পর থেকে। শিক্ষা খাতে সরকারি বরাদ্দ আগের চেয়ে বহুগুণ বৃদ্ধি পায়। নতুন প্রদেশের শিক্ষার হার ত্বরান্বিত করা ও শিক্ষার মান বৃদ্ধির জন্য প্রতিষ্ঠিত হয় ‘পূর্ব বাংলা ও আসাম প্রাদেশিক শিক্ষা বিভাগ’। এই শিক্ষা বিভাগ প্রাইমারি, সেকেন্ডারি ও কলেজ পর্যায়ে শিক্ষা বিস্তারের জন্য প্রয়োজনীয় পরিকল্পনা প্রণয়ন ও এর দ্রুত বাস্তবায়ন শুরু করে। পূর্ববঙ্গ ও আসাম প্রদেশ সৃষ্টির আগে এ অঞ্চলে ডিগ্রি পর্যায়ে মাত্র দুটি কলেজ ছিল- ঢাকা ও রাজশাহী কলেজ। প্রাইভেট কলেজগুলো কোন সরকারি সাহায্য পেত না এবং এগুলো ছিল অধিকাংশই অবকাঠামোশূন্য ও জরাজীর্ণ। এ অঞ্চলের কোন কলেজেই বিজ্ঞান শিক্ষার কোন সুযোগ ছিল না। শিক্ষা বিস্তারের লক্ষ্যে প্রদেশের বিভিন্ন অঞ্চলে সেকেন্ডারি স্কুল ও কলেজ স্থাপনের পরিকল্পনা নেয়া হয়। শিক্ষক স্বল্পতা ছিল একটি সাধারণ সমস্যা। অপেক্ষাকৃত বড় কলেজগুলোতে প্রয়োজনীয় সংখ্যক শিক্ষক নিযুক্ত করার ব্যবস্থা নেয়া হয়। ১৯০৬ সালে ঢাকা কলেজের শিক্ষক সংখ্যা ছিল মাত্র ১২ এবং তা ক্রমশ বেড়ে ১৯১১ সনে হয় ৩০ এবং শিক্ষকদের মধ্যে প্রিন্সিপালসহ ১২ জন শিক্ষক ছিলেন উচ্চতর ডিগ্রি প্রাপ্ত বৃটিশ নাগরিক। ১৯০৬ সালে চট্টগ্রাম কলেজের শিক্ষক সংখ্যা ছিল ৫ এবং তা উন্নীত হয়ে দাড়ায় ২০। প্রতিটি কলেজের অবকাঠামো উন্নত করা হয়। এর ফলে স্কুল এবং কলেজে দ্রুত ছাত্র সংখ্যা বাড়তে থাকে। কলেজে পাঠ্য করা হয় ফার্সি, সংস্কৃত, গণিত, ইতিহাস, বীজগণিত এবং বিজ্ঞানের বিবিধ বিষয়। ছাত্র শিক্ষকদের জন্য তৈরি হয় আবাসিক হোস্টেল ও বাসাবাড়ী। মুসলিম ছাত্রদের সুবিধার জন্য প্রত্যেক স্কুল ও কলেজে যথেষ্ট সংখ্যক সিট সংরক্ষিত রাখা হয়। ১৯০৬ থেকে ১৯১১ পর্যন্ত স্কুল পর্যায়ে মুসলিম ছাত্রদের উৎসাহিত করার জন্য নানা ধরণের বৃত্তি প্রবর্তন করা হয়। ১৯০৬ থেকে ১৯১১ পর্যন্ত স্কুল পর্যায়ে ছাত্র সংখ্যা বৃদ্ধি পায় বিশ শতাংশ। স্কুল শিক্ষকদের প্রশিক্ষণের জন্য প্রতিষ্ঠিত হয় কয়েকটি শিক্ষক প্রশিক্ষণ স্কুল। প্রতি জেলায় স্থাপন করা হয় একটি করে মহিলা স্কুল। অর্থাৎ বঙ্গ বিভাগের ফলে শিক্ষা ক্ষেত্রে পূর্ব বাংলায় অসাধারণ অগ্রগতি লক্ষ্য করা যায়।

পূর্ব বাংলা ও আসাম প্রদেশের নতুন রাজধানীতে নানা কর্মসংস্থান সৃষ্টি হয় এবং এর ফলে ঢাকা শহরের লোক সংখ্যা দ্রুত বাড়তে থাকে। ১৯১১ সালের আদম শুমারীতে দেখা যায় যে, ঢাকা রাজধানী হবার পর পাঁচ বছরের মধ্যে লোক সংখ্যা বৃদ্ধি পায় ২১%। সরকারি অফিস-আদালত ও অন্যান্য প্রয়োজনে ঢাকায় স্থাপিত হয় অনেক বড় বড় নতুন সরকারি স্থাপনা যা আজও বিদ্যমান। বর্তমান ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ও রমনা এলাকা ছিল নতুন রাজধানীর কেন্দ্রবিন্দু। নতুন রাজধানীর স্থাপনাগুলোর মধ্যে বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য বর্তমান  কার্জন হল, পুরনো হাইকোর্ট ভবন, সেক্রেটারিয়েট ভবন (বর্তমান ঢাকা মেডিক্যোল কলেজ হাসপাতাল ভবন), ঢাকা হল (বর্তমান শহীদুল্লাহ হল),  জগন্নাথ হল, গভর্ণর হাউজ (বর্তমান রাষ্ট্রপতি ভবন) এবং রমনার আরো কতিপয় স্থাপনা। ভারতের গভর্নর জেনারেল লর্ড কার্জন ছিলেন পূর্ববঙ্গ ও আসাম প্রদেশের রূপকার। তাঁর সম্মানে তখনকার আইন সভা ভবনের নাম দেয়া হয় কার্জন হল। পূর্ববঙ্গ ও আসাম প্রদেশের প্রথম ল্যাফটেন্যান্ট গভর্নর স্যার জোসেফ  ব্যামফিল্ড ফুলার (১৯০৫-০৬)এর আমলে নির্মিত নতুন রাজধানী ঢাকার একটি প্রধান সড়কের নাম রাখা হয় ফুলার রোড যা এখনো বর্তমান। প্রদেশের দ্বিতীয় ও সর্বশেষ লেফটেন্যান্ট গভর্নর স্যার ল্যাঞ্চলট হেয়ার (১৯০৬-১৯১১) এর স্মরণে নির্মিত হয়েছিল হেয়ার রোড। গভর্ণর জেনারেল লর্ড মিন্টোর (১৯০৫-১৯১০) নামে নির্মিত হয় মিন্টো রোড। সরকারি উচ্চপদস্থ কর্মচারীদের আবাসনের জন্য রমনা এলাকায় নির্মিত হয় অনেক স্থাপনা যার স্মৃতিচিহ্ন এখনো বিদ্যমান। যেমন, আমলাদের জন্য নির্মিত বেশ কয়েকটি বাংলোঘর, ঢাকা ক্লাব এবং রমনা রেসকোর্স। নতুন পূর্ববঙ্গ ও আসাম প্রদেশ এ অঞ্চলের মুসলমান সম্প্রদায়ের জন্য অনেক কল্যাণ বয়ে আনলেও বঙ্গভঙ্গ বিরোধী আন্দোলন মোকাবেলায় বঙ্গ বিভাগের পক্ষে মুসলমান সম্প্রদায়ের মধ্য থেকে কোনো জোরালো আন্দোলন হয়নি। এমনকি পূর্ববঙ্গের হিন্দু মধ্যবিত্ত শ্রেণির সংখ্যাগরিষ্ঠ অংশও এ বিভাগকে সমর্থন করেনি। বিদ্যমান পরিস্থিতিতে সরকার চেষ্টা করেছে মুসলমানদের মধ্যে বঙ্গ বিভাগের পক্ষে জনমত গড়ে তুলে হিন্দু বিরোধীতার মোকাবিলা করতে। কিন্তু তাদের এ চেষ্টা সফল হয়নি। এর কারণ, পূর্ববঙ্গে মুসলিম মধ্যবিত্ত শ্রেণি ছিল তুলনামূলকভাবে সংখ্যায় কম এবং সাম্প্রদায়িক রাজনীতির ব্যাপারে তাদের অনীহা ছিল। মুসলিম মধ্যবিত্ত শ্রেণির একটি ক্ষুদ্র অংশ ছিল বঙ্গভঙ্গ বিরোধী হিন্দু মধ্যবিত্ত শ্রেণির সঙ্গে একাত্ত। বঙ্গভঙ্গ বিরোধী কর্মীবৃন্দ মুসলমান সমাজে একটি সন্দেহ সৃষ্টি করতে সক্ষম হয়েছিল এ মর্মে যে, হিন্দু মুসলমানের মধ্যে বিভেদ সৃষ্টির জন্যই এ পদক্ষেপ গ্রহণ করা হয়েছিল।

সরকারের প্রচ্ছন্ন উৎসাহ এবং বঙ্গভঙ্গ বিরোধী আন্দোলনের পটভূমিতে ঢাকায় ১৯০৬ সালে মুসলিম লীগ প্রতিষ্ঠিত হয়। ঢাকার নবাব স্যার সলিমুল্লাহকে পূর্ব বাংলার মুসলিম সমাজের নেতা হিসেবে প্রতিষ্ঠিত করার লক্ষ্যে সরকার তাঁর ব্যক্তিগত বিপুল ঋণ পরিশোধের ব্যবস্থা করে। কিন্তু তিনি বঙ্গভঙ্গ বিরোধীদেরকে নিরুৎসাহিত করার মতো তেমন কোন বড় ধরনের প্রতিরোধ আন্দোলন সৃষ্টি করতে পারেননি। এদিকে স্বদেশী আন্দোলন, বিপ্লবী সন্ত্রাসী আন্দোলন ও কংগ্রেস-এর জাতীয়তাবাদী আন্দোলন সরকারের ওপর এক ক্রমবর্ধমান চাপ সৃষ্টি করতে সক্ষম হয়। এই চাপের বিপরীতে মুসলমান নেতৃত্ব কোন কার্যকরী পাল্টা আন্দোলন সৃষ্টি করতে ব্যর্থ হয়। এর কারণ মুসলিম সমাজের সার্বিক পশ্চাদপদতা। ১৯০১ সালের আদম শুমারী অনুযায়ী ইংরেজি ভাষাজ্ঞানসম্পন্ন মুসলমানের সংখ্যা ছিল প্রতি ১০,০০০ জনের মধ্যে মাত্র ২২ জন এবং হিন্দুদের মধ্যে ছিল ১১৪ জন। সরকারি উচ্চ পদে মুসলমানদের সংখ্যা ছিল মাত্র ৪১টি, আর হিন্দুদের ছিল ১২৩৫টি। অথচ সংখ্যার দিক দিয়ে মুসলমানরা ছিল হিন্দুদের তুলনায় প্রায় দ্বিগুণ। অতএব একটি সফল রাজনৈতিক আন্দোলন গড়ে তুলতে যে শিক্ষা, সচেতনা ও অর্থনৈতিক শক্তি থাকা দরকার তা পূর্ববঙ্গের মুসলমানদের মধ্যে ছিল অনুপস্থিত। এরই পটভূমিতে দাঙ্গা হাঙ্গামার পরিবেশে বঙ্গভঙ্গ বিরোধী আন্দোলন যখন তুঙ্গে এবং একই সময়ে পূর্ববঙ্গের মুসলমান সমাজ যখন সরকারের সহায়ক কোন ভূমিকা পালনে ব্যর্থ, তখন বিদ্যমান পরিস্থিতিতে সরকার ১৯১১ সালের ডিসেম্বর মাসে বঙ্গভঙ্গ রদ ঘোষণা করতে বাধ্য হয়। আসামকে আবার আগের মতো কমিশনারের শাসনাধীনে নেয়া হয়। অর্থাৎ রাজনৈতিকভাবে বাংলা আবার পূর্বেকার অবস্থানে প্রত্যাবর্তন করে। রাজধানী হিসেবে ঢাকা আবার একটি মফস্বল শহরে পরিণত হয়, এবং পূর্ব বঙ্গ আবার কলকাতার পশ্চাদভূমিতে রূপান্তরিত হয়

http://bn.banglapedia.org/index.php?title=%E0%A6%AA%E0%A7%82%E0%A6%B0%E0%A7%8D%E0%A6%AC%E0%A6%AC%E0%A6%99%E0%A7%8D%E0%A6%97_%E0%A6%93_%E0%A6%86%E0%A6%B8%E0%A6%BE%E0%A6%AE

তিনি যেমনটি বলেছেন, “ আসাম আমার, পশ্চিমবঙ্গ আমার ত্রিপুরাও আমার। এগুলো ভারতের কবল থেকে ফিরে না পাওয়া পর্যন্ত বাংলাদেশের স্বাধীনতা ও মানচিত্র পূর্ণতা পাবে না।”
আন্দোলন ভারতে ব্রিটিশ শাসনের অবসানের প্রাক্কালে সাম্প্রদায়িক প্রশ্নজনিত সমস্যার সমাধানে একটি রাজনৈতিক প্রস্তাব। ১৯৪৭ সালের এপ্রিল-মে দেশবিভাগের প্রশ্নটি পরিষ্কার হয়ে ওঠে। এ সময়ে বাংলার প্রধানমন্ত্রী হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দী আনুষ্ঠানিকভাবে অবিভক্ত বাংলাকে স্বাধীন ও সার্বভৌম রাষ্ট্র করার এক পরিকল্পনা পেশ করেন। প্রায় যুগপৎ শরৎচন্দ্র বসুও তাঁর সার্বভৌম সমাজতান্ত্রিক বাংলা প্রজাতন্ত্রের এক প্রস্তাব উত্থাপন করেন। সোহরাওয়ার্দী ও শরৎ বসুর মধ্যে বাংলার সার্বভৌম মর্যাদা কি হবে তা নিয়ে মতপার্থক্য ছিল। কিন্তু তাঁদের উভয়েরই প্রাথমিক উদ্দেশ্য ছিল বাংলা প্রদেশের বিভক্তি রোধ করা।

সোহরাওয়ার্দী ভারত ইউনিয়নের বাইরে সম্পূর্ণভাবে এক স্বাধীন রাষ্ট্র হিসেবে যুক্ত বাংলাকে দেখতে চেয়েছিলেন। কিন্তু শরৎ বসু অবিভক্ত বাংলাকে কল্পনা করেছিলেন ভারত ইউনিয়নের মধ্যেই এক সার্বভৌম সমাজতান্ত্রিক প্রজাতন্ত্র হিসেবে। তাঁরা উভয়েই বাংলা বিভাগের তীব্র প্রতিবাদ জানান। এ বিভক্তির উদ্যোগ নিয়েছিলেন কংগ্রেসের সংখ্যাগরিষ্ঠ নেতৃবৃন্দ এবং এ প্রদেশের হিন্দু মহাসভার নেতারা। বাংলার কতিপয় হিন্দু ও মুসলিম নেতা সোহরাওয়ার্দী ও শরৎ বসুর প্রয়াসের সমর্থন জানিয়েছিলেন। এঁদের মধ্যে বিশিষ্ট ব্যক্তিবর্গ হলেন: কিরণশঙ্কর রায় (বঙ্গীয় ব্যবস্থাপক সভার কংগ্রেস সংসদীয় দলনেতা), সত্যরঞ্জন বখশী (শরৎ বসুর সচিব), আবুল হাশিম (বাংলা প্রাদেশিক মুসলিম লীগের সম্পাদক), ফজলুর রহমান (বাংলা প্রদেশের রাজস্ব মন্ত্রী), মুহম্মদ আলী (সোহরাওয়ার্দী মন্ত্রিসভার অর্থমন্ত্রী) ও আরও অনেকে। প্রস্তাবটি কিছুকাল ধরে বিভিন্ন সরকারি-বেসরকারি সংস্থায় আলোচিত হয় এবং বাংলার তৎকালীন নেতাদের মধ্যে এ নিয়ে ঐকমত্যে আসার জন্য গুরুত্বপূর্ণ আলোচনা চলে।

প্রকৃতপক্ষে সার্বভৌম স্বাধীন বাংলার ধারণার উৎস নিহিত ছিল আরও অতীতে। ১৯৪০ সালের মার্চে গৃহীত লাহোর প্রস্তাব ভারতের দুটি মুসলিম সংখ্যাগরিষ্ঠ অঞ্চলের মুসলমানদের জন্য পৃথক আবাসভূমির দাবি তুলে ধরার পথে এক তাৎপর্যপূর্ণ পদক্ষেপ। কিন্তু ১৯৪৬ সালের এপ্রিল মাস অবধি লাহোর প্রস্তাব সুনির্দিষ্টভাবে সংজ্ঞায়িত করা হয়নি। বাংলার মুসলিম লীগ নেতৃবৃন্দের নিকট পাকিস্তান পরিকল্পনাটি ছিল প্রধানত ভারতের দুটি মুসলিম সংখ্যাগরিষ্ঠ অঞ্চলে দুটি পৃথক সার্বভৌম ও স্বাধীন রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠা করার প্রস্তাব। এ বিষয়ে সংখ্যাগরিষ্ঠ অভিমতের প্রতিনিধিত্বকারী সোহরাওয়ার্দী ও আবুল হাশিম গোটা বাংলা ও আসাম এবং সে সঙ্গে মুসলিম সংখ্যাগরিষ্ঠ এলাকা বিহারের পূর্ণিয়া জেলা নিয়ে বৃহত্তর বাংলা প্রতিষ্ঠার পক্ষে ছিলেন।খাজা নাজিমউদ্দীন (বাংলা ও একই সঙ্গে নিখিল ভারত মুসলিম লীগের ওয়ার্কিং কমিটির অন্যতম প্রভাবশালী সদস্য) ও মওলানা মোহাম্মদ আকরম খাঁ (বাংলা মুসলিম লীগের সভাপতি) ছিলেন এ ব্যাপারে সংখ্যালঘিষ্ঠ মতের প্রবক্তা। তাঁরা হিন্দু সংখ্যাগরিষ্ঠ বর্ধমান বিভাগ বাদ দিয়ে অবশিষ্ট বাংলা, গোটা আসাম এবং বিহারের পূর্ণিয়া জেলার কিছু অংশ নিয়ে অধিকতর এক সমশ্রেণীভুক্ত পাকিস্তান আশা করেছিলেন।

জিন্নাহ ১৯৪৬ সালের ৭-৯ এপ্রিল দিল্লিতে মুসলিম ব্যবস্থাপকদের এক সম্মেলনে এ ব্যাপারে আনুষ্ঠানিকভাবে তাঁর অভিমত প্রকাশ করেন। এখানে তাঁর পাকিস্তানের সংজ্ঞা বাংলায় তাঁর অনুসারীদেরকে পাকিস্তান প্রশ্নে তাঁদের পূর্বতন অবস্থান পুনর্বিবেচনা করতে প্ররোচিত করে। তাঁরা এখন জিন্নাহর অখন্ড পাকিস্তানের অবস্থাকে সমর্থন করতে থাকেন। প্রস্তাবিত পাকিস্তান গঠিত হবে ভারতের উত্তর-পূর্বাঞ্চলে গোটা বাংলা ও আসাম এবং উত্তর পশ্চিমাঞ্চলের পাঞ্জাব, সিন্ধু, বেলুচিস্তান ও উত্তর পশ্চিম সীমান্ত প্রদেশ নিয়ে। তবে এমন সম্ভাবনা বিশ্বাসযোগ্য বলে মনে হয় এ কারণে যে, বাংলা লীগের হাশিম-সোহরাওয়ার্দী গ্রুপের ধারণা ছিল পূর্ব পাকিস্তান কার্যত হবে বৃহত্তর বাংলা নিয়ে এক স্বাধীন ও সার্বভৌম রাষ্ট্র। কেননা, এ রকম একটি রাষ্ট্রই লাহোর প্রস্তাবে উল্লিখিত পাকিস্তান পরিকল্পনার সঙ্গে সম্পূর্ণ সঙ্গতিপূর্ণ মনে হয়েছিল। এ আদর্শে অনুপ্রাণিত হয়ে সোহরাওয়ার্দী ও হাশিম উভয়ে কিছুকাল পরে শরৎ বসু ও কিরণশঙ্কর রায়ের মতো প্রাদেশিক কংগ্রেস নেতাদের সঙ্গে আলোচনার মাধ্যমে এক স্বাধীন অবিভক্ত বাংলা গঠনের উদ্যোগ গ্রহণ করেন। বাস্তবিকপক্ষে, হিন্দুরা বাংলা বিভক্তির জন্য সংগঠিত আন্দোলন শুরু করার বহু পূর্বে এমনকি, কলকাতার ভয়াবহ সাম্প্রদায়িক দাঙ্গার (আগস্ট ১৯৪৬) পূর্বেই এ ধরনের ধ্যানধারণা সোহরাওয়ার্দীর মধ্যে বিরাজমান ছিল।

১৯৪৭-এর ফেব্রুয়ারিতে তৎকালীন ব্রিটিশ প্রধানমন্ত্রী এটলি-র ঘোষণার পর ভারতের স্বাধীনতার বিষয়টি দৃশ্যত নিকটতর হয়ে ওঠায় এবং ওই ঘোষণার পর পাঞ্জাব ও বাংলা প্রদেশকে বিভক্ত করার পক্ষে ভারতের জাতীয় কংগ্রেসে যুক্তিতর্কের আলোকে সোহরাওয়ার্দীসহ বাংলার অল্পসংখ্যক রাজনীতিক এক সার্বভৌম রাষ্ট্র হিসেবে বাংলা প্রদেশের সংহতি রক্ষার চিন্তা করেন। তারা বাংলাকে তার নিজস্ব সংবিধানসহ একটি স্বয়ংসম্পূর্ণ রাষ্ট্র গঠন করার প্রয়োজনীয়তা উপলব্ধি করেন। বাংলার তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী প্রদেশে একটি কোয়ালিশন সরকার গঠনের বিষয়েও বিশেষ গুরুত্ব আরোপ করেন। তিনি আরও জোর দিয়ে উল্লেখ করেন যে, বাংলা বাঙালিদের ও এ বাংলা অবিভাজ্য। এ প্রদেশের একটি অংশ অন্যটির ওপর নির্ভরশীল, আর তাই এখানকার সকলেই এর প্রশাসনে অংশীদার হওয়ার অধিকারী। তিনি এ আশা পোষণ করেন যে, বাংলাকে এক গৌরবময় দেশ হিসেবে গড়ে তুলতে সেখানকার সকল শ্রেণীর মানুষ সম্প্রীতিতে বাস ও কাজ করতে দৃঢ়সংকল্প। সোহরাওয়ার্দী মনে করেন যে, যখন এ স্বাধীনতা অর্জিত হবে তখন বাংলায় শান্তি ও সমৃদ্ধির এক নবযুগের সূচনা হবে। আবুল হাশিম বাংলার কংগ্রেস ও মুসলিম নেতাদের প্রতি তাঁদের নিজেদের সমস্যা ব্রিটিশ প্রশাসনের আওতার বাইরে শান্তিপূর্ণ ও সুখকরভাবে নিষ্পত্তিতে সম্মিলিতভাবে প্রয়াসী হওয়ার আবেদন জানান। বাংলা প্রাদেশিক কংগ্রেস নেতাদের মধ্যে শরৎ বসু অবিভক্ত বাংলার প্রশ্নে প্রধানমন্ত্রী সোহরাওয়ার্দীর সঙ্গে ঐকমত্য পোষণ করেন।

১৯৪৭ সালের এপ্রিল-মে’র দিনগুলিতে হিন্দু মালিকানাধীন সংবাদপত্র ও রাজনীতিকেরা বাংলা বিভাগের পক্ষে অপ্রতিরোধ্য আন্দোলন শুরু করে দেয়। ১৯৪৭-এর ফেব্রুয়ারি মাসে ব্রিটিশ কর্তৃপক্ষের ঘোষণায় ভারত বিভাগের বিষয়টি স্পষ্ট হয়ে ওঠে। দেশ বিভাগ অনিবার্য- এ বিষয়টি কংগ্রেস ও হিন্দু মহাসভা নেতাদের কাছে পরিষ্কার হওয়ার পর তাঁরা বাংলার হিন্দু সংখ্যাগরিষ্ঠ অঞ্চল এবং পাঞ্জাবের শিখ সংখ্যাগরিষ্ঠ অঞ্চল ভারত ইউনিয়নের মধ্যে রেখে দেওয়ার ব্যাপারে সঙ্কল্প প্রকাশ করেন। বাংলা প্রাদেশিক কংগ্রেস কমিটি আনুষ্ঠানিকভাবে বাংলা প্রাদেশিক বিভাগ এবং ভারত ইউনিয়নের মধ্যে কলকাতাকে অন্তর্ভুক্ত করে একটি স্বতন্ত্র হিন্দু সংখ্যাগরিষ্ঠ প্রদেশ (পশ্চিম বঙ্গ) গঠনের পক্ষে আনুষ্ঠানিক ঘোষণা প্রদান করে।

প্রায় একই সময়ে বাংলার প্রাদেশিক হিন্দু মহাসভা এ মর্মে দৃঢ় সিদ্ধান্ত ঘোষণা করে যে, বাংলার হিন্দুরা, অন্ততপক্ষে বাংলার হিন্দু সংখ্যাগরিষ্ঠ অঞ্চলসমূহ, অবশ্যই ভারত ইউনিয়নের মধ্যে থাকবে এবং উক্ত অঞ্চলসমূহকে ভারতের অবশিষ্ট অঞ্চল থেকে বিচ্ছিন্ন করা যাবে না। এ ব্যাপারে শ্যামাপ্রসাদ মুখার্জি বাংলা কংগ্রেস এবং দেশের কেন্দ্রীয় ও প্রাদেশিক আইন সভাগুলির বাঙালি হিন্দু সদস্যদের সমর্থন তাঁর পক্ষে আনতে সমর্থ হন। ঠিক এ পর্যায়ে যখন কংগ্রেস-হিন্দু মহাসভা অাঁতাত সাফল্যের সঙ্গে বাংলা বিভক্তির জন্য তাঁদের অভিযান সফলভাবে চালিয়ে যাচ্ছিল, তখন সোহরাওয়ার্দীও বাংলা সম্পর্কিত তাঁর পরিকল্পনা আনুষ্ঠানিকভাবে, ঘোষনা দেন। ১৯৪৭ সালের ২৭ এপ্রিল দিল্লিতে এক সম্মেলনে সোহরাওয়ার্দী তাঁর স্বাধীন অবিভক্ত বাংলার পরিকল্পনা প্রকাশ করেন। এরপর আবুল হাশিম ১৯৪৭-এর ২৯ এপ্রিল কলকাতায় প্রদত্ত এক বিবৃতিতে একই ইস্যুতে তাঁর অভিমত ঘোষণা করেন। এর কয়েকদিন পর শরৎ বসু তাঁর সার্বভৌম সমাজতান্ত্রিক বাংলা প্রজাতন্ত্রের প্রস্তাব উত্থাপন করেন।

এসব পরিকল্পনা সাধারণভাবে ভারতের এবং বিশেষ করে, বাংলার দুটি প্রধান ধর্মীয় সম্প্রদায়ের মধ্যে পারস্পরিক অবিশ্বাসের পরিবেশে উত্থাপিত হয়। লাহোর প্রস্তাব গৃহীত হওয়ার পরবর্তীকালে জিন্নাহর নেতৃত্বে পরিচালিত পাকিস্তান আন্দোলন বাংলার মুসলমানদের মধ্যে জনপ্রিয়তা লাভ করে। বাংলা প্রাদেশিক মুসলিম লীগ পাকিস্তান দাবির সমর্থনে মুসলিম জনসাধারণের অভিমত সংগঠিত করতে শুরু করে। বাংলার কংগ্রেস ও হিন্দু মহাসভার নেতৃবৃন্দ সারা বাংলার পাকিস্তানিকরণের সম্ভাবনায় দারুণ উদ্বিগ্ন হয়ে ওঠেন। সাম্প্রদায়িক উত্তেজনা বৃদ্ধির কারণে এ প্রদেশে কংগ্রেস ও মুসলিম লীগের মধ্যে সমঝোতা স্থাপন কঠিন হয়ে ওঠে। পাকিস্তান অর্জনের জন্য নিখিল ভারত মুসলিম লীগের প্রত্যক্ষ সংগ্রাম কর্মসূচিতে পরিস্থিতির আরও অবনতি ঘটে। অন্যান্য প্রদেশে এ প্রত্যক্ষ সংগ্রাম দিবস শান্তিপূর্ণভাবে পালিত হলেও কলকাতায় এ দিবস সহিংসতায় রূপ নেয়। এখানে সরকার ছিল মুসলিম লীগের নিয়ন্ত্রণাধীনে। ফলে বাংলা প্রাদেশিক বিভাগের দাবির অনুকূলে হিন্দু জনমত গঠনে এর প্রচন্ড প্রভাব পড়ে।

বাংলা প্রাদেশিক হিন্দু মহাসভা ও এ প্রদেশের কংগ্রেস নেতারা সার্বভৌম বাংলা পরিকল্পনা উপেক্ষা করেন। তাঁরা সোহরাওয়ার্দীর উদ্যোগের বিরুদ্ধে বাঙালি হিন্দুদের একটি বিরাট অংশকে সংগঠিত করেন। তাঁদের মতে, সোহরাওয়ার্দীর এ উদ্যোগ সারা বাংলায় পাকিস্তান প্রতিষ্ঠার একটি রাজনৈতিক কৌশল মাত্র। হিন্দু সংবাদপত্রগুলি ঐক্যবদ্ধভাবে অবিভক্ত বাংলা প্রস্তাবের বিরুদ্ধে হিন্দু জনমত গড়ে তোলার কোনো চেষ্টাই বাদ রাখে নি। হিন্দু মহাসভা বাংলার কংগ্রেস সদস্যদের ওপর বিপুল প্রভাব বিস্তার করে।

বাংলার কংগ্রেস সদস্যদের অধিকাংশ যখন স্বাধীন বাংলার জন্য সোহরাওয়ার্দীর পরিকল্পনার বিরোধিতা করে, তখন প্রদেশের মুসলিম লীগ মহলগুলির মনোভাবও বিভক্তির পক্ষে চলে আসে। বাংলা মুসলিম লীগের বৃহত্তর অংশ তথা জিন্নাহর অনুসারীরা খাজা নাজিমউদ্দীন ও মওলানা আকরাম খানের নেতৃত্বে দাবি করতে থাকে যে, বাংলা একক পাকিস্তান রাষ্ট্রের অবিচ্ছেদ্য অংশ হবে, কোনো স্বাধীন রাষ্ট্র নয়। জিন্নাহ যেমন পাকিস্তান সম্পর্কে অনমনীয় ছিলেন, নাজিমউদ্দীন, আকরাম খান ও তাঁদের অনুসারীরাও ঠিক তেমন অনড় ছিলেন। তাঁরা জিন্নাহর দ্বিজাতি তত্ত্বে দৃঢ় বিশ্বাসী ছিলেন।

কংগ্রেস ও মুসলিম লীগের সংখ্যাগরিষ্ঠ নেতাদের বিরোধিতা সত্ত্বেও সোহরাওয়ার্দী ও আবুল হাশিম তাঁদের পরিকল্পনার ভিত্তিতে প্রদেশের হিন্দু নেতাদের সঙ্গে একটি সমঝোতায় পৌঁছানোর প্রয়াস অব্যাহত রাখেন। সোহরাওয়ার্দী নানা সময়ে বিষয়টি নিয়ে ফ্রেডারিক বারোজ, জিন্নাহ ও মাউন্টব্যাটেনের সঙ্গে বৈঠকে মিলিত হন এবং তাঁদের সঙ্গে তাঁর সন্তোষজনক আলোচনাও হয়। শরৎ বসু মার্চে নিখিল ভারত কংগ্রেস কমিটি (AICC) কর্তৃক গৃহীত প্রস্তাবের তীব্র প্রতিবাদ করেন। কিরণশঙ্করের বিশ্বাস ছিল যে, যদি মুসলিম লীগ নেতৃবৃন্দ হিন্দুদের জন্য এমন কিছু প্রস্তাব নিয়ে এগিয়ে আসেন, তাহলে প্রদেশটির অখন্ডতা রক্ষা পেতে পারে। ১৯৪৭-এর মে মাসের গোড়ার দিক থেকে অবিভক্ত বাংলার পক্ষপাতীরা একে অন্যের কাছাকাছি আসেন। কলকাতায় গান্ধীর সফরকালে তাঁরা তাদের প্রস্তাব নিয়ে গান্ধীর সঙ্গে দেখা করেন এবং তাঁর পরামর্শ কামনা করেন। তাঁরা তাঁদের অভিমত সম্পর্কে কংগ্রেস ও লীগ শীর্ষ নেতাদের বোঝানোর চেষ্টা করেন। পরিশেষে

নিজেদের মধ্যে এক সমঝোতায় উপনীত হওয়ার পর সোহরাওয়ার্দী, কিরণশঙ্কর রায় ও শরৎচন্দ্র বসু তাঁদের এ পরিকল্পনার পরীক্ষামূলক চুক্তির শর্তগুলির ব্যাপারে কংগ্রেস ও লীগ হাই কমান্ডের অনুমোদন আদায়ের চেষ্টা করেন। তবে কংগ্রেস ও লীগ নেতাদের মধ্যে তৎকালে বিরাজমান ভুল বোঝাবুঝি ও পরিবর্তনশীল রাজনৈতিক পরিস্থিতির আলোকে এ সমঝোতার প্রণেতারা দারুণ উদ্বিগ্ন হয়ে পড়েন। কংগ্রেস ও লীগের সংখ্যাগরিষ্ঠ নেতারা চুক্তির শর্তগুলির সরাসরি নিন্দা করেন। কলকাতার প্রভাবশালী দৈনিক সংবাদপত্র এবং বঙ্গীয় প্রাদেশিক মুসলিম লীগের খাজা গ্রুপের সংবাদপত্রগুলি চুক্তির শর্তগুলির বিরুদ্ধে প্রচারাভিযান শুরু করে। খাজা গ্রুপের এ ধারণা হয় যে, এ চুক্তির অর্থ হবে হিন্দুদের কাছে পুরোপুরি আত্মসমর্পণ, আর কংগ্রেস ও হিন্দু মহাসভা নেতাদের মতে, এ চুক্তিটি পাকিস্তানের সীমানা সম্প্রসারণের একান্ত লক্ষ্যেই করা হয়েছে।

বাংলা প্রাদেশিক মুসলিম লীগের ওয়ার্কিং কমিটি ১৯৪৭-এর ২৮ মে আকরাম খানের সভাপতিত্বে অনুষ্ঠিত সভায় এ নিরীক্ষামূলক চুক্তির শর্তগুলির নিন্দা করে এবং লীগের পাকিস্তান দাবির প্রতি অবিচল ও জিন্নাহর নেতৃত্বে পূর্ণ আস্থা রাখার কথা পুনর্ব্যক্ত করে। এরপর ১৯৪৭ সালের ২৮ মে তারিখে প্রদত্ত ভারতীয় কংগ্রেসের নিখিল ভারত কংগ্রেস কমিটির সাধারণ সম্পাদকের এক বিবৃতি অবিভক্ত বাংলার ফর্মুলাকে আরও একদফা বিপর্যস্ত করে। ভারতীয় কংগ্রেসের পথ ধরে বাংলা প্রাদেশিক কংগ্রেসের সম্পাদক কালীপদ মুখার্জি এ পরিকল্পনা প্রত্যাখ্যান করে ১৯৪৭ সালের ১ জুন এক বিবৃতি প্রদান করেন।

সর্বভারতীয় রাজনীতিতে স্বাধীন সার্বভৌম বাংলা প্রস্তাবের বিরুদ্ধে প্রধান বিরোধিতা আসে ভারতের জাতীয় কংগ্রেসের পক্ষ থেকে। কংগ্রেস হাইকমান্ড অবিভক্ত বাংলায় মুসলমানদের স্থায়ী আধিপত্যের সম্ভাবনায় শঙ্কিত হন। জওহরলাল নেহরু ও সর্দার বল্লভভাই প্যাটেল সার্বভৌম বাংলার ধারণার ব্যাপারে ঘোর বিরোধী ছিলেন। নেহরুর ধারণা ছিল যে, এ পরিকল্পনার মাধ্যমে বাংলার মুসলিম লীগ কার্যত গোটা বাংলাকে পাকিস্তানে যোগ দিতে বাধ্য করবে। তিনি আরও মনে করতেন যে, যদি বাংলা অবিভক্ত থাকে তবে তা ভারতীয় ইউনিয়নের একটি অংশ হওয়া উচিত। তিনি পরিষ্কারভাবে বলেন যে, কংগ্রেস স্বতন্ত্র বাংলা রাষ্ট্রকে পাকিস্তানের গুরুত্বপূর্ণ সংযোজনা হিসেবে গণ্য করবে।

সর্দার প্যাটেল অবিভক্ত বাংলার উদ্যোগের বিরুদ্ধে প্রতিরোধ সংগঠিত করার প্রস্তাব দেন। ১৯৪৭-এর এপ্রিল থেকে জুনের মধ্যে বাংলার প্রভাবশালী হিন্দু নেতাদের সঙ্গে তাঁর যোগাযোগ থেকে বোঝা যায়, হিন্দুদের বাংলা বিভক্তির দাবির নেপথ্যে তাঁর নির্দেশক ভূমিকা ছিল এবং সেসঙ্গে সার্বভৌম বাংলা ধারণার বিপক্ষে তার উগ্র মনোভাবের কথাও জানা যায়। বাংলার যেসব হিন্দু নেতা ওই প্রদেশের মুসলিম লীগ নেতাদের সঙ্গে এ নিয়ে আলোচনায় সংশ্লিষ্ট ছিলেন প্যাটেল তাঁদের নিন্দা করেন। উল্লিখিত নিরীক্ষামূলক চুক্তির শর্তগুলির ব্যাপারে মুসলিম লীগ হাই কমান্ডের দৃষ্টিভঙ্গিও খুব একটা অনুকূল ছিল না। এ বিষয়ে প্রথম দিকে জিন্নাহ কংগ্রেস হাইকমান্ডের মতো ঘোর বিরোধী ছিলেন না। এর থেকে পরিষ্কারভাবে বোঝা যায় যে, তিনি এ পরিকল্পনাকে উৎসাহিত করেছিলেন।

মাউন্টব্যাটেনের মতে, ভারতকে বিভক্ত করতে হলে পাঞ্জাব ও বাংলাকে ভাগ করতে হবে। তিনি এর পক্ষে যুক্তিও দেখিয়েছিলেন। এর পরিপ্রেক্ষিতে, জিন্নাহ গোড়ার দিকে স্বাধীন অবিভক্ত বাংলার প্রস্তাবে সম্মতি দিতেও আগ্রহী ছিলেন। তাঁর প্রধান বিবেচ্য বিষয় ছিল বাংলার বিভক্তি এড়ানো। তাতে করে স্বাধীন বাংলা ও পাকিস্তানের মধ্যে ভবিষ্যতে একটা মৈত্রী গড়ার সম্ভাবনা রয়েছে বিধায় তাঁর এ সম্মতি ছিল গৌণ বিকল্প। তবুও শেষাবধি তিনি এ ইস্যুর অনুকূলে মনস্থির করতে পারেন নি। সম্ভবত তিনি এ ধারণার আলোকেই উল্লিখিত উদ্যোগ প্রত্যাখ্যান করেছিলেন যে, এটি পাকিস্তান সম্পর্কিত বিশ্বাস থেকে বিচ্যুতি। তিনি উল্লিখিত পরীক্ষামূলক চুক্তিতে যে যুক্ত নির্বাচনের বিষয় সন্নিবেশিত রয়েছে সে বিষয়ে কোনো রেয়াত দিতে তৈরি ছিলেন না। বাংলার প্রধানমন্ত্রী আন্তরিকভাবে মনে করেছিলেন, বাংলা প্রদেশে একটি কোয়ালিশন মন্ত্রিসভা গঠিত হলে তা হবে বাংলার হিন্দু ও মুসলমানদেরকে আরও ঘনিষ্ঠতর করার পথে এক গুরুত্বপূর্ণ পদক্ষেপ। আর তাতে একই সঙ্গে এ প্রদেশের বিভক্তিও রোধ করা যাবে। কিন্তু জিন্নাহ কখনও বিষয়টিকে ততখানি জরুরি বলে বিবেচনা করেন নি। বাংলায় কোয়ালিশন মন্ত্রিসভা প্রশ্নে তাঁর ভেটো সোহরাওয়ার্দী-বসু ফর্মুলার জন্য অতীব গুরুতর বলেই প্রমাণিত হয়।

ব্রিটিশ কর্তৃপক্ষ সার্বভৌম স্বাধীন অবিভক্ত বাংলা ধারণার প্রতি সর্বাত্মকভাবে বৈরী ছিলেন এমন নয়। বাংলার তৎকালীন গভর্নর ফ্রেডারিক বারোজ প্রদেশটির আদৌ বিভক্তির পক্ষপাতী ছিলেন না। তিনি বরং সোহরাওয়ার্দী-বসু ফর্মুলার পক্ষপাতী ছিলেন এবং তা যাতে বাস্তবায়িত হয় সে জন্য তিনি যথাসাধ্য চেষ্টাও করেন। ভাইসরয়ও ভারত ও পাকিস্তানের ডোমিনিয়ন মর্যাদার সঙ্গে অবিভক্ত বাংলাকেও ওই একই মর্যাদা দিতে অনিচ্ছুক ছিলেন না। তিনি সোহরাওয়ার্দীকে এ মর্মে আশ্বাস দেন যে, লীগ ও কংগ্রেস হাইকমান্ড অনুমোদন করলে বাংলা নিয়ে যেকোনো নিস্পত্তি ব্রিটিশ কর্তৃপক্ষ মেনে নেবে। তবে ব্রিটিশ কর্তৃপক্ষকে সর্বভারতীয় দৃষ্টিভঙ্গি থেকে এ প্রশ্ন বিবেচনা করতে হবে। তাঁরা মাত্র একটি প্রদেশের স্বার্থের জন্য গোটা ভারতের নিরাপত্তার প্রশ্নে রফা করতে আগ্রহী ছিলেন না। তাই এ পরিকল্পনা যে ব্যর্থ হবে তা ছিল প্রায় পূর্বনির্ধারিত। এরপর কংগ্রেস ও লীগ হাইকমান্ড ভারত বিভক্তি এবং ভারত ও পাকিস্তান নামে দুটি ডোমিনিয়নের কাছে ক্ষমতা হস্তান্তর করার মাউন্টব্যাটেন পরিকল্পনা (১৯৪৭ সালের ৩ জুন) গ্রহণ করায় অবিভক্ত বাংলা ধারণার ওপর চূড়ান্ত আঘাত আসে। [চিত্তরঞ্জন মিশ্র]