রাস্ট্র ও নাগরিকতা ও বাঙ্গালী

রাষ্ট্র কি ?

রাষ্ট্র একটি রাজনৈতিক প্রতিষ্ঠান । রাষ্ট্র গঠনের অপরিহার্য উপাদান জনসমষ্টি। দেশ, জাতি ও রাষ্ট্র প্রত্যয়গুলি প্রায়ই এমনভাবে ব্যবহৃত হয় । দেশ বলতে নির্দিষ্ট ভৌগলিক বৈশিষ্ট্য ও রাজনৈতিক সীমারেখাবিশিষ্ট অঞ্চল বা ভূখন্ডকে বোঝায়। রাষ্ট্র একটি বিমূর্ত ধারণা। রাষ্ট্রকে দেখা যায় না, কল্পনা বা অনুধাবন করা যায়। কিন্তু সরকার মূর্ত। কারণ, যাদের নিয়ে সরকার গঠিত হয়, তাদের দেখা যায় ।

রাষ্ট্র (ইংরেজি: State) বলতে এমন এক রাজনৈতিক সংগঠনকে বোঝায় যা কোন একটি ভৌগোলিক এলাকা ও তৎসংশ্লিষ্ট এলাকার জনগণকে নিয়ন্ত্রণ করার সার্বভৌম ক্ষমতা রাখে । রাষ্ট্র হচ্ছে এমন এক সংগঠন যা নির্দিষ্ট ভূখন্ডে আইনানুগ বলপ্রয়োগের সব মাধ্যমের উপর একচ্ছত্র নিয়ন্ত্রণ রাখে । জাতি বলতে সেই জনগণকে বোঝানো হয়, যাদের রীতিনীতি, পূর্বপুরুষ, ইতিহাস ইত্যাদি একই। যেমন বাঙ্গালী জাতী হাজার বৎসরের পথ পরিক্রমায় আজো একটি স্বাধিন রাষ্ট্র হিসাবে টিকে আছে ।

কোনাে ভূখণ্ডে একটি জনগােষ্ঠী স্থায়ীভাবে বসবাস করলেই রাষ্ট্র গঠিত হতে পারে। তবে একটি রাষ্ট্র গঠনের জন্য কী পরিমাণ জনসমষ্টি প্রয়ােজন, এর কোনাে সুনির্দিষ্ট নিয়ম নেই । সুনির্দিষ্ট ভূখণ্ডে স্থায়ীভাবে বসবাসকারী, সুসংগঠিত সরকারের প্রতি স্বভাবজাতভাবে আনুগত্যশীল, বহিঃশত্রুর নিয়ন্ত্রণ হতে মুক্ত স্বাধীন জনসমষ্টিকে রাষ্ট্র বলে । রাষ্ট্র (অথবা নগররাষ্ট্র, কনফেডারেশন, রাজ্য) মূলত কতিপয় রাজনৈতিক কার্যকলাপের সমষ্টি যা সামন্ততান্ত্রিক ইউরোপ থেকে উদ্ভূত হয়েছে।

সার্বভৌমত্ব

সার্বভৌমত্ব ও সার্বভৌমত্ব রাষ্ট্র গঠনের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ ও অত্যাবশ্যকীয় উপাদান । এটি রাষ্ট্রের চরম, পরম ও সর্বোচ্চ ক্ষমতা। সার্বভৌমত্ব বলতে কোন দেশ বা রাষ্ট্রের নিজের অভ্যন্তরীন এবং অন্যান্যরাষ্ট্রের সঙ্গে সম্পর্ক নির্ধারণের চূড়ান্ত ক্ষমতাকে বোঝায়। সার্বভৌমত্ব কোনো পরিচালনা পর্ষদের বাইরের কোনো উৎস বা সংগঠনের হস্তক্ষেপ ছাড়া কাজ করার পূর্ণ অধিকার ও ক্ষমতা।

বন্ধু রাষ্ট্র

“রাষ্ট্র” ধারণার সঙ্গে “বন্ধু রাষ্ট্র” ধারনাটা সাংঘর্ষিক। সাধারনত বন্ধুভাবাপন্ন রাষ্ট্রকে বন্ধু রাষ্ট্র বলা হলেও । ইতিহাসের পাতায় সকল বন্ধু রাষ্ট্রই বন্ধুত্বের সুযোগে আরেক রাষ্ট্রকে দখল করেছে । দুটো রাষ্ট্র আলাদা হয় এই কারণেই যে দুই রাষ্ট্রের কিছু মৌলিক ভিন্নতা আছে; এবং এই মৌলিক ভিন্নতা পরস্পরের প্রতিযোগী। মৌলিক ভিন্নতা না থাকলে দুই রাষ্ট্র হওয়ার কোন যৌক্তিকতা থাকেনা। এক রাষ্ট্র সব সময়েই আরেক রাষ্ট্রের প্রতিযোগী। একটা রাষ্ট্র সবসময়েই আরেকটা রাষ্ট্রের প্রতিযোগী এবং প্রচ্ছন্ন ও সাম্ভব্য শত্রু। 

রাষ্ট্র কিভাবে গঠিত হয়

রাষ্ট্র কোনাে একটি বিশেষ কারণে হঠাৎ করে সৃষ্টি হয়নি। দীর্ঘদিনের বিবর্তনের মাধ্যমে সমাজের বিভিন্ন স্তরে বিভিন্ন শক্তি ও উপাদান ধীরে ধীরে পরিবর্তিত হতে হতে রাষ্ট্রের উৎপত্তি হয়েছে। যেসব উপাদানের কার্যকারিতার ফলে রাষ্ট্রের উৎপত্তি হয়েছে, সেগুলাে হলাে সংস্কৃতির বন্ধন,রক্তের বন্ধন, ধর্মের বন্ধন, যুদ্ধবিগ্রহ, অর্থনৈতিক ও রাজনৈতিক চেতনা ও কার্যকলাপ । অতীত ইতিহাস ও রাজনৈতিক ঘটনাপ্রবাহ পরীক্ষা-নিরীক্ষা করে রাষ্ট্রের উৎপত্তি সম্পর্কে কতগুলাে মতবাদ রয়েছে । উল্লেখযােগ্য হলাে- ১। ঐশী মতবাদ, ২। বল বা শক্তি প্রয়ােগ মতবাদ, ৩। সামাজিক চুক্তি মতবাদ ও ৪। ঐতিহাসিক বা বিবর্তনমূলক মতবাদ

১) ঐশী মতবাদ

রাষ্ট্রের উৎপত্তি সম্পর্কে সবচেয়ে পুরাতন মতবাদ। এ মতবাদে বলা হয়- বিধাতা বা স্রষ্টা স্বয়ং রাষ্ট্র সৃষ্টি করেছেন এবং রাষ্ট্রকে সুষ্ঠুভাবে পরিচালনার জন্য তিনি শাসক প্রেরণ করেছেন ।

২। বল বা শক্তি প্রয়ােগ মতবাদ

এ মতবাদের মূল বক্তব্য হলাে- বল বা শক্তি প্রয়ােগের মাধ্যমে রাষ্ট্রের উৎপত্তি হয়েছে এবং শক্তির জোরে রাষ্ট্র টিকে আছে। এ মতবাদে বলা হয়, সমাজের বলশালী ব্যক্তিরা যুদ্ধ-বিগ্রহ বা বল প্রয়ােগের মাধ্যমে দুর্বলের উপর নিজেদের আধিপত্য স্থাপনের মাধ্যমে রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠা করে । যেমন ইংরেজরা বাংলা ও ভারতের বিভিন্ন অংশ দখল করে নাম দেয় ” ঈন্ডিয়া ” । আবার আদি বঙ্গদেশকে ভেঙ্গে তা ভারত ও পাকিস্তানের হাতে তুলে দেয় ।স্সৃষ্টি পশ্চিম বঙ্গ পুরব বঙ্গ আসাম ও ত্রিপুরা – যা এক বাংলা রাষ্ট্রের অধিনে৩ ছিল হাজার বৎসর । সৃষ্টির শুরু থেকে আজ পর্যন্ত এভাবেই যুদ্ধ বিগ্রহের মাধ্যমে রাষ্ট্রের জন্ম হয়েছে । বাঙ্গালিরা ১৯৭১ সালে যুদ্ধ করে ১৭৫৭ সালে পলাশির প্রান্তরে স্বাধিনতার অস্তমিত সূর্যকে জাগিয়ে তুলে ।

৩। সামাজিক চুক্তি মতবাদ

এ মতবাদের মূলকথা হলাে- সমাজে বসবাসকারী জনগণের পারস্পরিক চুক্তির ফলে রাষ্ট্রের জন্ম হয়েছে । যেমন ভারতের বিভিন্ন জাতী ও ভাষার মানুশেরা ব্রিটিশদের কথামত একসাথে বসবাস করে হিন্দি ভাষাকে নিজেদের ভাষা বলে মেনে নিয়েছে ।

৪। ঐতিহাসিক বা বিবর্তনমূলক

রাষ্ট্রের উৎপত্তি সম্পর্কিত বিভিন্ন মতবাদের মধ্যে ঐতিহাসিক বা বিবর্তনমূলক মতবাদ সবচেয়ে যুক্তিযুক্ত ও গ্রহণযােগ্য মতবাদ । বর্তমানের রাষ্ট্র বহুযুগের বিবর্তনের ফল । যেমন বাংলাদেশ বাঙ্গালী জাতীর হাজার যুগের বিবর্তনের ধারা ।

নাগরিক

যে ব্যক্তি কোনাে রাষ্ট্রে স্থায়ীভাবে বসবাস করে, রাষ্ট্রের প্রতি আনুগত্য স্বীকার করে, রাষ্ট্রপ্রদত্ত অধিকার ভােগ করে এবং রাষ্ট্রের প্রতি কর্তব্য পালন করে, তাকে ঐ রাষ্ট্রের নাগরিক বলে । নাগরিক হলাে ব্যক্তির পরিচয়। যেমন- আমাদের পরিচয় আমরা বাংলাদেশের নাগরিক। আর রাষ্ট্রের নাগরিক হিসেবে ব্যক্তি যে মর্যাদা ও সম্মান ও অধিকার রাষ্ট্র থেকে পেয়ে থাকে তাকে নাগরিকতা বলে ।

নাগরিক ও জাতীয়তা

আন্তর্জাতিক প্রথাগত আইন এবং আন্তর্জাতিক রীতি অনুযায়ী, এটি প্রত্যেক রাষ্ট্রের অধিকার যা নির্ধারণ করে কারা সেই রাষ্ট্রের নাগরিক হবে । জাতীয়তা, নাগরিকতা থেকে কারিগরি এবং আইনগত ভাবে পৃথক, যা বাক্তি এবং দেশের মধ্যে পৃথক ধরনের আইনগত সম্পর্ক। জাতীয়তা বিশেষ্য পদটি নাগরিক এবং অনাগরিক উভয়কেই বোঝাতে পারে । নাগরিকের সবচেয়ে সাধারন পার্থক্যকারি বৈশিষ্ট্য হচ্ছে নাগরিক রাষ্ট্রের রাজনৈতিক জীবনে অনশগ্রহন করতে পারে ।

যেমন আমরা বাংলাদেশে সংবিধান মতে জাতী হিসাবে বাঙ্গালী জাতী – এবং সংবিধানের মূলমন্ত্রে রয়েছে বাঙ্গালী জাতীয়তাবাদ – কিন্তু সকল বাঙ্গালিরাই বাংলাদেশি নয় । বাংলাদেশের নাগরিকরা বাংলাদেশি রাষ্ট্রগত ভাবে – বাঙ্গালী জাতিগত ভাবে । এই রাস্ট্রের মুল্মন্ত্র হিসাবে বাঙ্গালিরা বাংলাদেশের নাগরিকিত্ব পেতে সরবোচ্চ অগ্রাধিকার পাবে । একজন ব্যাক্তি বিভিন্ন দেশের নাগরিক হতে পাড়ে কিনতি জাতিগত ভাবে সে নির্দিষ্ট কোন এক জাতীর অন্তর্ভুক্ত ।

আন্তর্জাতিক আইনে জাতীয়তা হচ্ছে একটি অবস্থা অথবা সম্পর্ক যা একটি জাতিকে পৃথক একটি জাতি থেকে রক্ষা করার অধিকার প্রদান করে । নাগরিকতা এমন একটি অবস্থা যা একটি জাতিকে কোন ব্যক্তি উপর অধিকার প্রদান ঈবং বিধি নিষেধ প্রদান করে । জাতীয়তা একটি বা অন্য রাষ্ট্রের ভেতরে রাজনৈতিক অধিকারের জন্য প্রয়োজনীয় তবে যথেষ্ট নয়। জাতীয়তা পূর্ণ নাগরিকত্ত পাওয়ার জন্য প্রয়োজন এবং কিছু জনগনের পূর্ণ নাগরিকত্ত ছাড়া জাতীয়তা আছে। ঐতিহাসিকভাবে একজন জাতীয় ও নাগরিকের মধ্যে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ পার্থক্য হচ্ছে নাগরিকের প্রতিনিধি নির্বাচন করার এবং নিরবাচিত হওয়ার অধিকার আছে

বাঙালি জাতীয়তাবাদ


Leave a Reply