স্বাধীনতা নাকি স্বায়ত্তশাসন ? বঙ্গবন্ধু কী চেয়েছিলেন ?

২০১০ সালের বিজয় দিবসে তৎকালীন বিএনপির মহাসচিব খোন্দকার দেলোয়ার হোসেন বিজয় দিবস উপলক্ষে আলোচনা সভায় প্রথম বলেন,
“আ’লীগ নেতা শেখ মুজিব নিজেই স্বাধীনতা চাননি। তিনি চেয়েছেন স্বায়ত্ত শাসন। “ এরপরে ২০১৪ সালের বিজয় দিবস উপলক্ষে লণ্ডন বিএনপির আলোচনা সভায় তারেক রহমান একই কথা বলেন। ধরে নেয়া যায় এই প্রসঙ্গে এটাই বিএনপির অফিসিয়াল স্ট্যান্ড।
বিএনপি বুদ্ধি করে যেভাবে স্বাধীনতা আর স্বায়ত্তশাসনকে মিউচুয়ালি এক্সক্লুসিভ বলে উপস্থাপন করেছে সেটায় বিস্মিত হতে হয়।
উনাদের এই বক্তব্যে আমার প্রতীতি হয়েছে পৃথিবীর দেশে দেশে জাতিসমুহের আত্মনিয়ন্ত্রণের অধিকার এবং স্বাধীনতার লড়াইয়ের ইতিহাসের রাজনৈতিক পাঠ হয় তারা নেননি অথবা সচেতনভাবে এই বিষয়টির একটি উদ্দেশ্যমুলক উপস্থাপন করেছেন। দুটোই ইতিহাস পাঠের জন্য ক্ষতিকর।
স্বায়ত্তশাসন এবং স্বাধীনতার প্রশ্নটি জাতীয়তাবাদী নেতারা কীভাবে দেখতেন সেই প্রসঙ্গে আমি চিনের জাতীয়তাবাদী নেতা চিয়াং কাই শেকের একটি চমৎকার উধৃতি দিতে চাই যা মৌলানা আবুল কালাম আজাদের ইন্ডিয়া উইনস ফ্রিডম বইয়ের ৪২ পাতায় চিয়াং কাই শেকের বয়ানে বলা আছে। চিয়াং কাই শেক ভারতে এসেছেন দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে কংগ্রেসকে ব্রিটিশ সরকারকে সহায়তা করানোর জন্য রাজি করতে। কংগ্রেস এদিকে বেঁকে বসে আছে এই দাবী তুলে যে ব্রিটিশরা ভারতকে স্বাধীনতা না দিলে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে ভারতীয়রা ব্রিটিশদের সহযোগিতা করবে না। চিয়াং কাই শেক আলোচনার শুরুতেই কংগ্রেস নেতাদের কী বলছেন লক্ষ্য করুন।
“A dependent nation could achieve freedom in only one of two ways. It could take to the sword and expel the foreigner. Alternatively, it could achieve its freedom by peaceful methods but this meant that advance towards freedom would be gradual. There would be progress towards self-government step by step till the goal was reached. These are the only methods open to a nation which is fighting against either a foreign or a national despot.
China was a clear example of the validity of this principle. The National Movement in China began in 1911 but it had to pass through many stages before freedom was attained. India would also have to follow the same path. Indians must, of course, decide how they would achieve their goal. There was no alternative to the position that if freedom could not be attained at one stroke, India should achieve it through gradual stages.”
“একটি পরাধীন দেশ তার স্বাধীনতা অর্জন করতে পারে কেবল দুটোর একটি পন্থায়-হয় সশস্ত্র হয়ে সে বিদেশীকে মেরে তাড়াতে পারে; নয় শান্তিপূর্ণ পদ্ধতিতে সে তার স্বাধীনতা লাভ করতে পারে-কিন্তু তার মানে হবে, পর্যায়ক্রমে স্বাধীনতার লক্ষ্যের দিকে এগোনো। যতদিন লক্ষ্যসাধন না হয়, ততদিন স্বায়ত্তশাসনের দিকে ধাপে ধাপে এগোতে হবে। বিদেশী অথবা জাতীয় স্বৈরতন্ত্রের বিরুদ্ধে যে দেশ লড়াই করছে, তার সামনে মাত্র এই দুটি পথই খোলা আছে।
এই নীতি যে ঠিক, তার স্পষ্ট নজির হল চীনদেশ। চীনদেশে জাতীয় আন্দোলন শুরু হয় ১৯১১ সালে; কিন্তু স্বাধীনতা অর্জন করতে অনেকগুলো স্তর পেরোতে হয়েছে। ভারতকেও সেই একই পথ অনুসরণ করতে হবে। অবশ্য ভারতবাসীদের এটা ঠিক করতে হবে যে, তারা কিভাবে তাদের লক্ষ্য হাসিল করবে। পথ বলতে একটাই- এক চোটে স্বাধীনতা না মিললে ভারতকে তা অর্জন করেত হবে ধাপে ধাপে। এর বিকল্প নেই।”
স্বায়ত্তশাসন স্বাধীনতা অর্জনের প্রথম ধাপ; স্বাধীনতার প্রতিপক্ষ নয় যে স্বায়ত্তশাসন চাইলে স্বাধীনতার আকাঙ্খ্যাকে বলি দিয়ে চাইতে হবে। এটা পৃথিবীর সব রাজনীতিবিদেরা জানেন, কিন্তু জানেন না শুধু উনারা। বাঙালিরাও স্বাধীনতার লক্ষ্যে স্বায়ত্তশাসনের দাবিতে লড়াই গড়ে তুলেছিল।
রাজনৈতিক লড়াইয়ের মধ্যে দিয়েই ধাপে ধাপে স্বাধীনতা অর্জনের পথে অগ্রসর হওয়াই বাঙালি নেতাদের লক্ষ্য ছিল।
রাজনৈতিক লড়াইয়ের মধ্যে দিয়ে স্বাধীনতা অর্জনের পথ দীর্ঘ হলেও সেই পথে রক্তপাত আর প্রাণহানি এড়ানো যেত, এবং তার ফলে জাতির জীবনে দীর্ঘস্থায়ী ক্ষত তৈরি হওয়াও বন্ধ করা যেত।
কিন্তু ১৯৭১ এর ২৫শে মার্চ পাকিস্তানী বাহিনী গণহত্যা শুরু করে যুদ্ধ আমাদের উপরে চাপিয়ে দেয়; তাই ধাপে ধাপে স্বাধীনতা অর্জনের পথ রুদ্ধ হয়ে যায়। চিয়াং কাই শেক বর্ণিত “এক চোটে” স্বাধীনতা পাওয়ার জন্য রক্তক্ষয়ী সশস্ত্র লড়াই শুরু করতে হয় আমাদের।
তাই “শেখ মুজিব স্বায়ত্তশাসন চেয়েছেন স্বাধীনতা চাননি” এই বক্তব্যটি রাজনৈতিক বক্তব্য হিসেবে ইনভ্যালিড এবং ইম্ম্যাচিউর।