সন্ত্রাস ও জঙ্গিবাদ প্রতিরোধে ইসলাম- বাংলাদেশ ইসলামিক ফাউন্ডেশন

ইসলাম শান্তির ধর্ম। আল্লাহ্‌তায়ালা আমাদের প্রিয়নবী হযরত মুহম্মদ (সা.)-কে দুনিয়ার বুকে প্রেরণ করেছেন বিশ্ব জাহানের রহমতস্বরূপ (রাহমাতুল্লিল আল-আমীন)। বিশ্বশান্তি প্রতিষ্ঠা এবং মানব কল্যাণই হচ্ছে ইসলামের শাশ্বত সৌন্দর্য ও অন্যতম ভিত্তি। পৃথিবীর নানা দেশে যুগে যুগে মানুষ এই সৌন্দর্যের প্রতি আকৃষ্ট হয়ে ইসলামের সুশীতল ছায়াতলে আশ্রয় নিয়েছে এবং শান্তির ঠিকানা পেয়েছে। বর্তমানেও ইসলামের শাশ্বত সৌন্দর্যের প্রতি মুগ্ধ হয়ে মানুষ দলে দলে ইসলামে দীক্ষিত হচ্ছে। বিশেষ করে ইউরোপসহ পাশ্চাত্য বিশ্বে মুসলমানদের সংস্পর্শে এসে এবং ইসলামের দাওয়াতের ফলে ইসলাম গ্রহণকারীর সংখ্যা যে হারে বৃদ্ধি পাচ্ছে তাতে ইসলাম বিদ্বেষীরা রীতিমতো আতঙ্কিত। ইসলামের দাওয়াতের পথ রুদ্ধ করার ষড়যন্ত্র: ইউরোপ ও পশ্চিমা বিশ্বের মানুষকে ইসলামের প্রতি অনুরাগী হওয়ার গতিকে রুদ্ধ করার জন্য ইসলাম বিদ্বেষীরা নানামুখী পরিকল্পনা বাস্তবায়ন ও ষড়যন্ত্র করছে। তারা তাদের ধর্মানুসারীদের কাছে ইসলামকে একটি সন্ত্রাসী ও জঙ্গিবাদী ধর্ম হিসেবে পরিচিত করতে চায়। এ পরিকল্পনা বাস্তবায়নে তারা মুসলিম সমাজে অত্যন্ত সুকৌশলে আল-কায়েদা, আইএস, বোকো হারাম, আনসারুল্লাহ, লস্কর-ই-তৈয়্যেবা, জেএমবি, হিযবুত তাহ্‌রীর ইত্যাদি সন্ত্রাসী জঙ্গিবাদী দল-উপদল সৃষ্টি করেছে। তাদের উদ্দেশ্য হচ্ছে সন্ত্রাস-জঙ্গিবাদ ও বিপ্লবের মাধ্যমে রাষ্ট্রক্ষমতা দখল ও সম্পদের মালিক হওয়া। মধ্যপ্রাচ্যের ব্রাদারহুড ও বাংলাদেশের মওদূদীপন্থি জামায়াত-শিবিরও একই আদর্শে অনুপ্রাণিত ও পরিচালিত। বর্তমানে বাংলাদেশে সক্রিয় জেএমবি, হিযবুত তাহ্‌রীর ও আনসরুল্লাহ বাংলা টিমসহ নামে বেনামে সক্রিয় সবক’টি জঙ্গি সন্ত্রাসী ও উগ্রবাদী গোষ্ঠী সংস্থা প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষভাবে জামায়াত থেকেই উৎসারিত এবং জামায়াত দ্বারা নিয়ন্ত্রিত। রাষ্ট্রক্ষমতা দখলই এদের একমাত্র উদ্দেশ্য। পূর্বে ইহুদি নাসারারা তাদের নিজেদের লেবাসে ইহুদি-নাসারা নামেই ইসলামের দুশমনী করতো; বর্তমানে তারা কৌশল পাল্টিয়ে মুসলিম নামধারী মুনাফিক জামায়াত-শিবিরগংদের মাধ্যমে মুসলিম লেবাসে ইসলামেরই নামে এই ইসলামের দুশমনী করে চলছে। তাদের এই বিধ্বংসী অপকৌশল বর্তমানে অ্যাটমিক বোমার চেয়েও ভয়ঙ্কর।
ইহুদি-নাসারাদের এজেন্ডা বাস্তবায়ন করছে জামায়াত-শিবির: বাংলাদেশসহ আমাদের এই অঞ্চলে দীর্ঘকাল ধরে ইহুদি-নাসারাদের এজেন্ডা বাস্তবায়ন করছে জামায়াত-শিবির মুনাফিক চক্র। ইহুদিদের লক্ষ্য যেমন সম্পদের পাহাড় গড়ে তুলে বিশ্বের কর্তৃত্ব অর্জন করা তেমনি জামায়াত-শিবিরের লক্ষ্য হচ্ছে- ইসলামী ব্যাংকিং-বীমা ব্যবস্থার আড়ালে সুদী লেনদেন পরিচালনার মাধ্যমে সম্পদ অর্জন করা এবং সে সম্পদ দ্বারা রাষ্ট্রীয় ক্ষমতা দখলের অপপ্রয়াস চালিয়ে ইহুদি-নাসারাদের এজেন্ডা বাস্তবায়ন করা। এ কাজে আইএস-এর মতো জামায়াত-শিবিরও কৌশলে বাংলাদেশের তরুণ ও যুব সমাজকে ব্যবহার করছে। ব্যবহার করছে তাদের, যারা হতাশাগ্রস্ত, পারিবারিক বন্ধন থেকে বঞ্চিত এবং ধর্মের সঠিক জ্ঞান যাদের মাঝে নেই কিন্তু ধর্মের প্রতি রয়েছে প্রবল আকর্ষণ। এই তরুণ-যুবসমাজকে পবিত্র কুরআন-হাদীসের কিছু বিক্ষিপ্ত আয়াত ও বাণী শুনিয়ে জিহাদের অপব্যাখ্যা দিয়ে মগজ ধোলাই করে সন্ত্রাস ও জঙ্গিবাদের প্রতি অনুপ্রাণিত করছে তাদের মাধ্যমে কিলিং মিশন বাস্তবায়নের জন্য।
ইসলামে সন্ত্রাস ও জঙ্গিবাদের স্থান নেই: ফিতনা-সন্ত্রাস, জঙ্গিবাদ ও বিশৃঙ্খলা ইসলামে সম্পূর্ণ নিষিদ্ধ। এ প্রসঙ্গে আল্লাহ্‌তায়ালা বলেন, ‘ফিতনা বা সন্ত্রাস হত্যার চেয়েও ভয়াবহ’ (সূরা বাকারা, আয়াত: ১৯১)।
মানুষ হত্যা নিষেধ করে আল্লাহ্‌তায়ালা বলেন: ‘কেউ কাউকে নরহত্যার অপরাধ অথবা পৃথিবীতে ফাসাদ সৃষ্টির কারণ ব্যতীত হত্যা করলে সে যেন গোটা মানবতাকে হত্যা করলো। আর কেউ কারো প্রাণ বাঁচালে সে যেন গোটা মানবজাতিকে বাঁচালো’ (সূরা মায়িদা, আয়াত: ৩২)। মহানবী (সাঃ) বিদায় হজের ভাষণেও মুসলিম উম্মাহ্‌কে সতর্ক করে বলেন: ‘শুনে রাখ! মুসলমান পরস্পর ভাই ভাই। সাবধান, আমার পরে তোমরা একজন আরেকজনকে হত্যা করার মতো কুফরি কাজে লিপ্ত হয়ো না।’ কুরআন-সুন্নাহ্‌র এই নির্দেশনা মান্য করে চললে সন্ত্রাস ও জঙ্গিবাদ কখনোই মুসলিম সমাজে মাথা চাড়া দিয়ে উঠতে পারে না।
মহানবী (সাঃ)-এর হাদীস অনুযায়ী সন্ত্রাসীরা অপরিপক্ক ও নির্বোধ: ইসলামের নামে সন্ত্রাসী কর্মকাণ্ড এবং বিপর্যয় সৃষ্টিকারীদের সম্পর্কে নবী করীম (সাঃ) বলেছেন: ‘শেষ জামানায় এমন একটি গোষ্ঠীর আবির্ভাব ঘটবে যারা হবে বয়সে নবীন, বুদ্ধিতে অপরিপক্ক ও নির্বোধ। তারা পবিত্র কুরআন পাঠ করবে কিন্তু তা তাদের কণ্ঠনালীও অতিক্রম করবে না। (অর্থাৎ হৃদয় স্পর্শ করবে না)। তারা সৃষ্টির সেরা মানুষের কথাই বলবে কিন্তু দ্বীন থেকে এমনভাবে বেরিয়ে যাবে যেমন ধনুক থেকে তীর শিকার ভেদ করে বেরিয়ে যায়’ (তিরমিযী, কিতাবুল বাব ২৪)। নবী করীম (সাঃ)-এর এই হাদীসের আলোকেই জঙ্গিবাদীদের প্রকৃত চিত্র বোঝা যায়। তাদের সাথে কোনো উচ্চশিক্ষিত দ্বীনদার হক্কানী আলেম-ওলামা নেই, নেই কোনো ইসলাম বিষয়ে বিশেষজ্ঞ ব্যক্তি। যারা ইসলাম বিদ্বেষীদের দ্বারা প্ররোচিত হয়ে বিভিন্ন নামে-বেনামে সন্ত্রাসী কর্মকাণ্ড পরিচালনা করছে তারা মূলতই মহানবী (সাঃ)-এর হাদীসে উল্লিখিত নবীন বা তরুণ সম্প্রদায়। কুরআন ও সুন্নাহ্‌র সঠিক শিক্ষা যাদের অন্তরকে স্পর্শ করেনি, অথচ এরাই বিশ্বব্যাপী ইসলাম প্রতিষ্ঠার নামে সন্ত্রাসী কর্মকাণ্ড চালাচ্ছে। তারা নবী করীম (সাঃ) এর মাধ্যমে আল্লাহ্‌ প্রদত্ত দাওয়াতী উসুল পরিবর্তন করে কুরআন-সুন্নাহ্‌-পরিপন্থি মনগড়াভাবে সন্ত্রাস ও ইঙ্গ তৎপরতাকে তাদের ধর্মের অবলম্বন বানিয়ে নিয়েছে।
মুনাফিকদের কবল থেকে বিশ্বের কোনো জনপদই নিরাপদ নয়: গত ৪ঠা জুলাই ২০১৬ পবিত্র রমজানের রাতে মুসলিম উম্মাহ্‌র কলিজার টুকরা মদীনার মসজিদে নববীর পাশে এই মুনাফিক চক্রই আত্মঘাতী বোমা হামলা চালায়। এতে হামলাকারীসহ ৬ জন নিহত হয়, তখন ২০ লাখ মুসল্লী মসজিদে নববীতে অবস্থান করছিলেন। ২৪ ঘণ্টায় তারা সৌদি আরবে ৩টি হামলা চালায়। গত ২রা জুলাই ২০১৬ রাতে বাংলাদেশের গুলশান হলি আর্টিজান রেস্তোরাঁয় একদল উচ্ছৃঙ্খল সন্ত্রাসী যুবা তরুণ মুনাফিক চক্রের কৌশল অবলম্বন করে দেশি-বিদেশি ২২ জন নিরপরাধ মানুষকে নৃশংসভাবে হত্যা করে। লেবাসধারী ভ্রান্ত আকিদার মুনাফিক চক্র বিশ্বের নানা প্রান্তের মানুষদেরকে আজ তাদের কবলে জিম্মি করার অপচেষ্টায় লিপ্ত। এই মুনাফিক চক্র ইসলাম এবং মুসলিম উম্মাহ্‌কে যেভাবে কলঙ্কিত ও লজ্জিত করছে তা থেকে উত্তরণের পথ একটাই: এদের বিরুদ্ধে সম্মিলিত প্রতিরোধ গড়ে তোলা, এদেরকে সর্বোতভাবে প্রতিহত করা।
সন্ত্রাস নয়, দাওয়াতই হচ্ছে ইসলামের সঠিক পথ: বিশ্ব জাহানের রহমত-রাহ্‌মাতুল্লিল আলামিন মহানবী (সাঃ) পৃথিবীতে এসেছিলেন মানুষের আত্মিক পরিশুদ্ধির মাধ্যমে ইহকালের কল্যাণ ও পরকালের নাজাতের পথ প্রদর্শক হিসেবে। তিনি দাওয়াতের মাধ্যমেই মানুষকে আল্লাহ্‌র পথে আহ্বান করেছিলেন। এ সম্পর্কে আল্লাহ্‌তায়ালা বলেন: ‘(হে রাসূল) আপনি মানুষকে আপনার প্রতিপালকের দিকে আহ্বান করুন হিকমত ও সৎ উপদেশের মাধ্যমে এবং তাদের সাথে কথা বলুন উত্তম পন্থায়’। আপনার প্রতিপালকের পথ ছেড়ে কে বিপথগামী হয় সে সম্পর্কে তিনি সবিশেষ অবহিত আছেন এবং কারা সৎপথে আছে সে বিষয়েও তিনি সম্যক অবহিত’ (সূরা নাহল, আয়াত: ১২৫)। দাওয়াতের পথই হচ্ছে ইসলামের প্রকৃত পথ। নবী করীম (সাঃ) এর ওফাতের পর সাহাবায়ে ক্বেরাম, তাবেয়ী, তাবে তাবেয়ী ও আউলিয়াগণ এ দাওয়াতের মাধ্যমে মানুষকে ইসলামে দীক্ষিত করেছেন। তাদের অনুপম চারিত্রিক আদর্শ ও ইসলামের পূতপবিত্র সৌন্দর্যের প্রতি আকৃষ্ট হয়ে মানুষ ইসলামের সুশীতল ছায়াতলে আশ্রয় গ্রহণ করেছে। আমাদের উপমহাদেশে আজ ৭০ কোটি মুসলমানের বাস। তারা এ অনুপম দাওয়াতেরই ফসল।
জঙ্গিবাদ প্রতিরোধে জামায়াতীদের কবল থেকে শিক্ষা ব্যবস্থা পুনরুদ্ধার করতে হবে: মওদূদীপন্থি জামায়াত-শিবির সারাদেশে কিন্ডারগার্টেনসহ বিভিন্ন ধরনের কোচিং সেন্টার, শিক্ষা প্রতিষ্ঠান পরিচালনার মাধ্যমে তাদের ভ্রান্ত আদর্শের কর্র্মীবাহিনী যেমন গঠন করছে, তেমনি গত পঞ্চাশ বছর ধরে তারা অত্যন্ত সুকৌশলে আমাদের শিক্ষা ব্যবস্থাকেও বিকৃত করেছে এর ফলে আলেম তৈরির পথে বাধা সৃষ্টি করছে। শিক্ষা কারিক্যুলামকে ধ্বংস করে তারা অর্ধশিক্ষিত ও আলেম নামধারী ব্যক্তির মাধ্যমে মওদূদীপন্থি কর্মী তৈরি করছে। এ অবস্থা থেকে বেরিয়ে আসতে হলে প্রকৃত আলেম সমাজকেই এগিয়ে আসতে হবে। সন্ত্রাস ও জঙ্গিবাদের পথ বন্ধ করার জন্য এর কোনো বিকল্প নেই।
নবী করীম (সাঃ) শুধু রাহমাতুল্লিল মুসলিমীন নন, তিনি ‘রাহমাতুল্লিল আল-আমীন: আল্লাহ্‌তায়ালা বিশ্বজগতের রহমত স্বরূপ নবী করীম (সাঃ)কে হায়াতুন্নবী বিশেষণে জমিনে প্রেরণ করেছেন। তিনি নবী করীম (সাঃ) এর মাধ্যমে ওহীর জ্ঞান পবিত্র কুরআন এবং নবী করীমের (সাঃ) কর্মময় জীবন সুন্নতকে দ্বীনী দাওয়াত ও দ্বীনী শিক্ষার ভিত্তি করেছেন। নবী করীম (সাঃ) এক্ষেত্রে বিশ্ববাসীর জন্য নমুনা অনুসরণ ও অনুকরণীয়। কিয়ামত পর্যন্ত তার নমুনার উপর ভিত্তি করে কুরআন-সুন্নাহ্‌র দাওয়াত ইহুদি, খ্রিস্টান, হিন্দু, বৌদ্ধ ও নাস্তিকসহ সকল বিশ্ববাসীর নিকট তার ধারাবাহিকতায় পৌঁছে দিয়েছেন- তার সাহাবায়ে-ক্বেরাম, তাবেঈন, তাবে তাবেঈন, উলামা ও আওলিয়া ক্বেরাম। নবী করীম (সাঃ) জোর করে কাউকে মুসলিম বানাতে আসেননি। যারা তাঁর দাওয়াতে সাড়া দিয়েছেন, তিনি তাদেরকে কলেমা পড়িয়েছেন, তিনি জমিনকে বা রাষ্ট্রকে কলেমা পড়াননি বা পড়াতে আসেননি। এ প্রসঙ্গে উল্লেখ্য, নবী করীম (সা.) ৬০৯ খ্রিস্টাব্দে নবুয়ত লাভ করেন। সেই নবুয়তকাল থেকে শুরু করে ১৯৪৭ খ্রিস্টাব্দ পর্যন্ত ১৩৩৭ বছরে নবী করীম (সা.), খোলাফায়ে রাশিদীন, সাহাবা-তাবিঈন এবং তাঁদের পরবর্তী কেউই রাষ্ট্রকে বা জমিনকে কলেমা পড়াননি অথবা ‘ইসলামিক স্টেট’ ‘মুসলিম স্টেট’ করেননি বা সেদিকে আহ্বানও করেননি। ১৯৪৭-এ পাকিস্তান প্রথম তার নামকরণ করে ‘ইসলামী প্রজাতন্ত্র’। এরপর ইরান, মৌরিতানিয়া ও চাঁদ তাদের দেশের নামের সাথে ‘ইসলামী রাষ্ট্র বা প্রজাতন্ত্র’ শব্দ যুক্ত করে। ওআইসিভুক্ত ৫৭টি রাষ্ট্রের বাকি ৫৩টি রাষ্ট্রের কোনোটিই তার নামের সাথে ‘ইসলামী রাষ্ট্র, রাজ্য, প্রজাতন্ত্রী’ জাতীয় কোন শব্দ সংযুক্ত করেনি। ইসলামি স্টেট বা মুসলিম স্টেট করার বিষয়ে পবিত্র কুরআন ও হাদিসে কোন নির্দেশনা নেই।
জামায়াত-শিবির পরিচালিত শিক্ষা-প্রতিষ্ঠান সন্ত্রাস-জঙ্গিবাদের অন্যতম উৎস: বাংলাদেশে জামায়াত-শিবিরের প্রতিষ্ঠিত ও পরিচালিত নামে-বেনামে কিন্টার গার্টেন, মডেল, আইডিয়াল, ক্যাডেট, পিস স্কুল, কলেজ, মাদরাসা ও সাধারণ/ইসলামী বিশ্ববিদ্যালয়ে নির্ধারিত কারিকুলামবহির্ভূত বেশ কিছু চটকদার চটিবইসহ মউদুদী দর্শনের পুস্তকাদি ও প্রচারপত্রের মাধ্যমে বিকৃত ধর্মীয় শিক্ষা প্রদান করা হয়; যা শিশু-কিশোর ও তরুণ-যুবকদের সন্ত্রাস-জঙ্গি মানসিকতা সৃষ্টির অন্যতম প্রধান উৎস। ইসলামের বিকৃত ব্যাখ্যাসহ এসব চটিবই পড়ানো রাষ্ট্রবিরোধী। তাই তা বন্ধ করতে হবে।
ইসলামী মাইক্রোক্রেডিট জামায়াত-শিবিরের পুনর্বাসন ও জঙ্গি অর্থায়নের নেটওয়ার্ক: দেশের প্রত্যন্ত অঞ্চলে গাছ কেটে, সড়কে বাধা সৃষ্টি করে এবং সরকার ও রাষ্ট্রবিরোধী মিছিল-মিটিং করে কোমলমতি শিক্ষার্থী ও সাধারণ ধর্মপ্রাণ মানুষদের সন্ত্রাস ও জঙ্গি তৎপরতা অনুশীলনের হাতেখড়ি প্রদান করা হয়। কোথাও প্রকাশ্যে এবং কোথাও পর্দার অন্তড়ালে এর নেতৃত্বে থাকে জামায়াত-শিবির। এক্ষেত্রে অর্থায়নের সুযোগটি সৃষ্টি হয় সমগ্র দেশে সর্বাধিক বিস্তৃত ইসলামী ব্যাংকিংয়ের নামে সুদি ধারার ইসলামী মাইক্রোক্রেডিটের মাধ্যমে। গ্রামীণ ব্যাংক, ব্র্যাক, আশা ও অন্যান্য এনজিওগুলো উচ্চহারে সুদভিত্তিক মাইক্রোক্রেডিট শুরু করলেও বর্তমানের মাইক্রোক্রেডিটের প্রধানতম নিয়ন্ত্রণ জামায়াত-শিবির পরিচালিত একটি ইসলামী নামের ব্যাংকের হাতে। এক্ষেত্রে কেবল ২০১৫ সালেই এ ব্যাংকটির পল্লী অঞ্চলে লোন/বিনিয়োগ গ্রহণের জন্য সদস্য করা হয়েছে প্রায় ১০ লক্ষ এবং লোন/বিনিয়োগ দেয়া হয়েছে প্রায় ৬ লক্ষ নারী পুরুষকে। বর্তমানে বাংলাদেশের মাইক্রোক্রেডিট সিংহভাগ পরিচালিত হয় এ ব্যাংটির মাধ্যমে। এ অর্থায়নের সাথে কর্মরত প্রায় আড়াই হাজার ফিল্ড অফিসার জামায়াত-শিবিরের রাজনীতির সাথে সম্পৃক্ত। ইসলামের নামে এ মাইক্রোক্রেডিট পরিচালনার দাবি করা হলেও এখানে সুদকে মুনাফা নাম দিয়ে ঘুরিয়ে-ফিরিয়ে ইসলামের নামে সুকৌশলে সুদিচর্চা হয় এবং জামায়াতি অপরাজনীতির স্লো-পয়জন ঢুকিয়ে দেয়া হয়। এই মাইক্রোক্রেডিট সূত্রে জামায়াত-শিবির পুনর্বাসিত হয় এবং তাদের দ্বারা অনুপ্রাণিত হয়ে তরুণ-যুবক জঙ্গি তৎপরতার দিকে পা বাড়ায়।
মুসলিম উম্মাহর মধ্যে বিভক্তি সৃষ্টিকারী এবং বিশ্বব্যাপী সন্ত্রাসের উস্কানিদাতা ডা. জাকির নায়েক ও পিস টিভির অপপ্রচার: ভারতের ডা. জাকির নায়েক তার পিস টিভির মাধ্যমে মুসলিম উম্মাহর মধ্যে বিভেদ সৃষ্টি করছে। পিস টিভির মাধ্যমে তিনি বিশ্বব্যাপী সন্ত্রাসের উস্কানি দিচ্ছে। তিনি একজন লা-মাযহাবী ও সালাফী। এদেশের জনগণের মধ্যে মাত্র শতকরা ২% লোক লা-মাযহাবী, সালাফী ও মওদুদীপন্থি জামায়াত-শিবিরচক্র। এরা ডা. জাকির নায়েকের মতাদর্শে বিশ্বাসী। তাদের উদ্দেশ্য হচ্ছে বিশ্বব্যাপী ইসলামী রাষ্ট্র কয়েম করে ক্ষমতায় আরোহণ করা। মধ্যপ্রাচ্যে জঙ্গি ও সন্ত্রাসী সংগঠন আইএস ২০২০ সালের মধ্যে ভারত উপমহাদেশে তাদের সাম্রাজ্য বিস্তারের ঘোষণা দেয়। এ লক্ষ্যে তারা বাংলাদেশকে করিডোর হিসেবে ব্যবহার করে মানচিত্র প্রণয়ন করেছে।
ডা. জাকির নায়েক ইসলামের নামে যেসব বিষয়ে বিভ্রান্তি ছড়াচ্ছে:
* ডা. জাকির নায়েক বলেছেন: ‘রাসুল (সা.) কো মাংনা হামারা লিয়া হারাম হ্যায়’ অর্থাৎ রাসুলুল্লাহ সা.)-কে চাওয়া বা মান্য করা আমাদের জন্য হারাম।
* তিনি রাসুল (সা.)-কে রাষ্ট্রপ্রধান হিসেবে উল্লেখ করেন। অথচ রাসুল (সা.) পৃথিবীতে এসেছিলেন রাহমাতুল্লিল আল-আমীন বা জগতসমূহের রহমত হিসেবে। তিনি ভৌগোলিক সীমায় কোন রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার জন্য আসেননি। পবিত্র ও হাদিসের কোথাও ইসলামী রাষ্ট্রের কথা উল্লেখ নেই।
* ডা. জাকির নায়েক বলেন, প্রত্যেক মুসলমানের সন্ত্রাসী হওয়া উচিত। এর মাধ্যমে তিনি মুসলিম সমাজে সন্ত্রাসবাদকে উস্কে দিচ্ছেন।
* ডা. জাকির নায়েক বলেন, আল্লাহর বাণী যাচাই করতে হবে আধুনিক বিজ্ঞানের মাধ্যমে। এর মাধ্যমে তিনি বিজ্ঞানকে কুরআনের ওপর স্থান দিয়েছেন।
* হযরত ঈমাম হোসাইন (রা.)-এর হত্যাকারী ইয়াজিদকে তিনি রাহমাতুল্লাহে আলাইহি বলে দোয়া করেন। এর মাধ্যমে তিনি আহলে বাইয়াতের বিরুদ্ধে অবস্থান নেন।
* মহানবী (সা.)-কে হায়াতুন্নবী (সা.) মর্মে আক্বিদাকে অস্বীকার করেন।
* ডা. জাকির নায়েক তুলনামূলক ধর্মতত্ত্বের নামে: ক. আল্লাহকে ভ্রাহ্ম, বিষ্ণু নামে ডাকা যাবে মর্মে মত দেন। খ. হিন্দুদের রামকৃষ্ণ নবী হতে পারেন বলে মত দেন। গ. হিন্দুদের বেদ আল্লাহর বাণী হতে পারে বলে মত দেন।
* ডা. জাকির নায়েক ওয়াসা বিন লাদেন-এর পক্ষ সমর্থন করে ধর্মী সন্ত্রাসবাদকে সমর্থন করেন।
* রমজান মাসে ফজরের আযান হলেও সাহরি খাওয়া যাবে বলে ফতোয়া দেন।
* ডা. জাকির নায়েক তাবলীগ জামায়াতের চিল্লার বিরোধিতা করেছেন।
* উপরে বর্ণিত ভুল ব্যাখ্যার কারণে ডা. জাকির নায়েককে বিভিন্ন দেশে নিষিদ্ধ ঘোষণা করা হয়েছে।
উপরে বর্ণিত ভুল ব্যাখ্যার কারণে ডা. জাকির নায়েকের বিরুদ্ধে-
* বিভিন্ন দেশের আলেম-ওলামাগণ ফতোয়া দিয়েছেন। তাকে কাফির, গোমরাহ পথভ্রষ্টকারী ও মুসলিম উম্মাহর বিভক্তি সৃষ্টিকারী ও ইসলাম ধ্বংসের ষড়যন্ত্রকারী বলে সর্বজন শ্রদ্ধেয় আলেম-ওলামাগণ ফতোয়া দিয়েছেন।
* ভারতের এলাহাবাদ হাইকোর্টে তার বিরুদ্ধে মামলা দায়ের, গ্রেপ্তারি পরোয়ানা জারি এবং লক্ষ্ণৌতে পিস টিভির সম্প্রচার বন্ধ করে দেয়া হয়।
* গ্লোবাল টেরোরিজম বিস্তারে মদদদান ও ওসমা বিন লাদেনকে সমর্থন করায় বৃটেনে তাকে নিষিদ্ধ করা হয়েছে। কানাডা সরকার তার ভিসা বাতিল করেছে।
* সমগ্র ভারতে পিস টিভির সম্প্রচার বন্ধ করে দেয়া হয়েছে।
* ভারত সরকার তার নামে গ্রেপ্তারি পরোয়ানা জারি করেছে।
বর্ণিত অবস্থায় নিম্নোক্ত পদক্ষেপগুলো গ্রহণ করা জরুরি-
* বাংলাদেশে পিস টিভির কার্যক্রম অবিলম্বে বন্ধ করা এবং এর সাথে জড়িতদের চিহ্নিত করে আইনানুগ ব্যবস্থা গ্রহণ করা।
* পিস টিভির সকল প্রকাশনা নিষিদ্ধ করা।
* সহজ-সরল ধর্মপ্রাণ মালিক ও পরিচালকদের ধর্ম-বিশ্বাসের সুযোগকে কাজে লাগিয়ে বিভিন্ন টিভি চ্যানেলে যেসব জামাতি, লা-মাযহাবী ও সালাফী কর্মীগণ ইসলামের নামে ভ্রান্ত মতবাদ প্রচার করছে তাদের বিরুদ্ধে কার্যকর পদক্ষেপ গ্রহণ করা।
দেশের সুশীল সমাজ ও বিশিষ্টজনরা মনে করেন:
দেশের সাম্প্রতিক জঙ্গিবাদী কর্মকাণ্ডে উচ্চবিত্ত পরিবারের সন্তানদেরকে ধর্মের অপব্যাখ্যা ও মগজ ধোলাইয়ের মাধ্যমে বিপথগামী করা হচ্ছে। ধর্মান্ধতা বা ধর্ম সম্পর্কে ভালোভাবে না জানা এবং বোঝার কারণেই কোমলমতি শিক্ষার্থীরা জঙ্গিবাদে জড়িয়ে পড়ছে। বেসরকারি শিক্ষা প্রতিষ্ঠান ও ইংরেজি মাধ্যমের শিক্ষার্থীদের জঙ্গিবাদে ঝুঁকে পড়ার প্রবণতা লক্ষ্য করা গেছে। সন্তানের প্রতি পিতামাতার অমনোযোগিতা কিংবা তাদের কাজকর্মের খোঁজ-খবর না রাখাও এজন্য দায়ী। জঙ্গিবাদের পারিবারিক সম্পর্ক অর্থাৎ ছেলেমেয়েদের সাথে অভিভাবকদের সম্পর্ক থেকে সন্তানরা পথনির্দেশনা পায় এবং তাদের জীবনে প্রভাব বিস্তার করে। বর্তমানে পরিবারে নৈতিকতা শিক্ষার প্রচলন নেই। সামাজিক মূল্যবোধ সম্পর্কে সচেতন নয়। নৈতিকতা শিক্ষা এবং সামাজিক মূল্যবোধের অভাবে ছেলেমেয়েরা জঙ্গিবাদের মতো জঘন্যতম কর্মকাণ্ডে যুক্ত হচ্ছে। শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে মানবিক ও সামাজিক মূল্যবোধের শিক্ষার অভাব, কারিকুলাম ও সিলেবাস অনুযায়ী পড়ানো হয় না। সুষ্ঠু সংস্কৃতি চর্চা না থাকা এবং ধর্মান্ধতার কারণে জঙ্গিবাদে জড়িয়ে বিপথগামী হচ্ছে শিক্ষার্থীরা।
পিতামাতা, শিক্ষক ও অভিভাবকদের প্রতি আহ্বান: ইসলাম যেভাবে শিক্ষা দিয়েছে পিতা-মাতা, শিক্ষক ও অভিভাবকগণ যদি তাদের সন্তান ও অধীনস্থদের প্রতি অনুরূপ দায়িত্বশীল আচরণ করেন তাহলে তাদের বিপথগামী হওয়ার সম্ভাবনা অনেকাংশে কমে যাবে। কোনো পিতামাতাই চান না তাদের সন্তান আত্মঘাতী বা সন্ত্রাসী হয়ে উঠুক। কাজেই আমাদের আহ্বান- আসুন, আমরা সবাই আমাদের সন্তানদের প্রতি যত্নবান হই এবং তারা বিপথগামীদের কবলে পা দিয়ে সন্ত্রাসী কর্মকাণ্ডে জড়িয়ে গেল কিনা এ ব্যাপারে সব সময়ই সতর্কতা অবলম্বন করি।


ইসলামিক ফাউন্ডেশন ‘সন্ত্রাস ও জঙ্গিবাদ প্রতিরোধে ইসলাম’- শীর্ষক একটি ভাষ্য তৈরি করেছে। তথ্য অধিদপ্তরের মাধ্যমে গণমাধ্যমে প্রচারের জন্য তা পাঠানো হয় । তা তুলে ধরা হোল