কোভিড-১৯ বা করোনা ভাইরাস মহামারি আকারে সারা বিশ্ব ছড়িয়ে পড়েছে। প্রতিদিন হাজারো মানুষ এই ভাইরাস দ্বারা সংক্রামিত হচ্ছে। তবে এই সংক্রমণের ক্ষেত্রে মানুষের রক্তের ভূমিকা কতটুকু পরিলক্ষিত হয় সেই বিষয়টি বিশ্বর অন্যতম গণমাধ্যম বিবিসি তার একটি প্রতিবেদনে তুুলে ধরেছে। নিম্নে প্রতিবেদনটি আলোচনা করা হলো।
আক্রান্ত কেউ কেউ অত্যন্ত দ্রুত গুরুতর অসুস্থ হয়ে পড়ছেন, কারো দেহে দেখা যাচ্ছে খুবই মৃদু উপসর্গ। আবার অনেকের ক্ষেত্রে করোনাভাইরাস পজিটিভ বলে নিশ্চিত হবার পরও কোন উপসর্গই দেখা যাচ্ছে না। তাই এই প্রশ্নটা বারবারই ঘুরে ফিরে আসছে – করোনাভাইরাসে গুরুতর অসুস্থ হবার ঝুঁকি কার ক্ষেত্রে কতটা? এটা কি আগে থেকে অনুমান করা এবং সে অনুযায়ী হুঁশিয়ার হওয়া সম্ভব?
এ নিয়ে বহু গবেষণা চলছে, প্রতিনিয়তই বিজ্ঞানীরা বিভিন্ন দিকের ওপর আলোকপাত করছেন। সম্প্রতি কিছু গবেষণায় বলা হচ্ছে, মানুষের রক্তের টাইপ বা গ্রুপের সাথে করোনাভাইরাসে আক্রান্ত হবার ঝুঁকির সম্পর্ক আছে।
বিজ্ঞানীরা প্রথম দিকে রক্তের টাইপের সাথে কোভিড সংক্রমণের সম্পর্ক আছে বলে মনে করতেন না।
তবে এখন গবেষকরা দেখছেন, এ দুটির মধ্যে সম্পর্ক আছে এবং এ, বি বা এবি টাইপ রক্তবিশিষ্ট লোকদের করোনাভাইরাসে সংক্রমিত বা গুরুতর অসুস্থ হবার ঝুঁকি বেশি ।
এমনকি কোভিড-১৯ এ কার মৃত্যুর ঝুঁকি কতটা – তার আভাস পেতেও সহায়ক হতে পারে রক্তের টাইপ। রক্তের টাইপের সাথে কোভিড-১৯ রোগ কীভাবে সম্পর্কিত? বিবিসির বিজ্ঞান ও স্বাস্থ্য বিষয়ক সংবাদদাতা হেলেন ব্রিগস লিখছেন, টুয়েন্টিথ্রিএ্যান্ডমি নামে একটি জেনেটিক টেস্টিং
কোম্পানির চালানো একটি গবেষণাতেও বলা হচ্ছে, যাদের রক্তের টাইপ ‘ও’ – তাদের কোভিড-১৯ পজিটিভ হবার সম্ভাবনা – এ, বি বা এবি টাইপের রক্তের লোকদের চাইতে ৯ থেকে ১৮ শতাংশ কম।
৭ লক্ষ ৫০ হাজার মানুষের ওপর জরিপ চালিয়ে দেখা গেছে, টেস্টে কোভিড পজিটিভ ফল পাওয়া গেছে এমন অংশগ্রহণকারীদের মধ্যে রক্তের টাইপ ‘ও’ এমন লোকের সংখ্যা সবচেয়ে কম।
কোভিড পজিটিভদের মধ্যে সবচেয়ে বেশি আছেন ‘এবি’ টাইপ রক্তের অধিকারীরা।
এই গবেষকরা দেখেছেন. করোনাভাইরাসে আক্রান্তের বয়স, লিঙ্গ, ওজন, জাতিগত বা নৃতাত্বিক বৈশিষ্ট্য এবং আগে থেকে থাকা স্বাস্থ্য সমস্যা – এগুলো বিবেচনায় নেবার পরও, কোভিড সংক্রমণে ঝুঁকির ক্ষেত্রে রক্তের টাইপের ভূমিকা একই থাকছে। গবেষকরা অবশ্য বলেছেন তাদের এই জরিপ এখনো প্রাথমিক স্তরে রয়েছে।
স্পেন, ইতালি ও চীনে চালানো জরিপেও একই রকম আভাস তবে অন্য একাধিক জরিপেও রক্তের টাইপের সাথে কোভিড সংক্রমণ কত মারাত্মক হবে তার একটা সম্পর্ক দেখা গেছে। গত সপ্তাহেই ইতালি ও স্পেনে চালানো জেনোমওয়াইড এ্যাসোসিয়েশনের চালানো এক জরিপে বলা হয়- করোনাভাইরাস আক্রান্ত রোগীদের মধ্যে যাদের রক্তের টাইপ ‘এ’ – তাদের অক্সিজেন বা ভেন্টিলেটরের প্রয়োজন হবার সম্ভাবনা বেশি।
মার্কিন দৈনিক দি নিউ ইয়র্ক টাইমস জানাচ্ছে, মানুষের জিন, রক্তের টাইপ এবং কোভিড-১৯ – এগুলোর মধ্যে পরিসংখ্যানগত সম্পর্ক প্রথম চিহ্ণিত করে ইউরোপের একটি জরিপ। নিউ ইংল্যান্ড জার্নাল অব মেডিসিনে
প্রকাশিত নিবন্ধে বলা হয়, ইতালি ও স্পেনের ৭টি হাসপাতালের ১,৯৮০ জন রোগীর ওপর এ জরিপ চালানো হয়।
এতে বলা হয়, ‘এ’ টাইপ রক্তের ক্ষেত্রে করোনাভাইরাস সংক্রমণে অসুস্থ হবার ঝুঁকি বেশি, এবং ও টাইপের ক্ষেত্রে ঝুঁকি তুলনামূলকভাবে কম বলে দেখা গেছে। বলা হয়, যাদের রক্তের টাইপ এ পজিটিভ – তাদের কোভিড-১৯ আক্রান্ত হলে অক্সিজেন বা ভেন্টিলেটর দরকার হবার সম্ভাবনা ৫০ শতাংশ বেশি।
এর আগে চীনে চালানো একটি জরিপেও এমন তথ্য পাওয়া যায়। মেডআরকাইভ অনলাইন জার্নালে প্রকাশিত ওই জরিপে বলা হয়, উহান ও শেনঝেনের তিনটি হাসপাতালের ২,১৭৩ জন করোনাভাইরাস রোগী এবং আক্রান্ত হয়নি এমন লোকদের উপাত্ত তুলনা করে দেখা গেছে, এ টাইপ রক্তের লোকদের কোভিড-১৯ আক্রান্ত হবার ঝুঁকি বেশি।
সেখানেও দেখা যায় ‘ও’ টাইপ রক্তের মানুষদের আক্রান্ত হবার ঝুঁকি কম। ‘সাবধানতা কমানোর জন্য এ জরিপকে ব্যবহার করবেন না’ তবে বিজ্ঞানীরা বলছেন, করোনাভাইরাস সংক্রমণ থেকে বাঁচার জন্য যেসব সাবধানতা অবলম্বন করতে হয় – তা পালন না করার জন্য এসব জরিপকে ব্যবহার করা ঠিক হবে না। ভারমন্ট বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক ড. মেরি কুশম্যান বলেন, “সামাজিক মাধ্যমে এমন কথা দেখা গেছে যে একটি পরিবারের যে সদস্যের রক্তের টাইপ ও – তাকে কেনাকাটা করার জন্য দোকানে পাঠানো উচিত কিনা। “
“কিন্তু কারো রক্তের টাইপ ‘ও’ বলে তাকে কম সাবধানতা অবলম্বন করতে হবে – এমন চিন্তা করা কারোরই উচিত হবে না। আমরা চাই না যে কারো রক্তের টাইপ ‘ও’ বলে সে নিজেকে সুরক্ষিত ভাববে – এমন ধারণা তৈরি হোক।“
এই গবেষণাগুলোর সাথে জড়িত বিজ্ঞানীরা বলেছেন, রক্তের টাইপই করোনাভাইরাস সংক্রমণের ঝুঁকির পেছনে প্রধান কারণ কিনা, বা এর পেছনে অন্য কোন জেনেটিক উপাদান কাজ করছে কিনা – তা এখনো স্পষ্ট নয়। রক্তের টাইপ নির্ধারিত হয় বংশানুক্রমিকভাবে মানুষের রক্তের টাইপ প্রধানত: চারটি – এ, বি, এবি এবং ও। প্রত্যেকের রক্তের টাইপ নির্ধারিত হয় তার পিতামাতার থেকে পাওয়া জিনের মাধ্যমে।
করোনাভাইরাস সংক্রমিত কিছু লোকের গুরুতর অসুস্থ হয়ে পড়া এবং অন্য কিছু লোকের ক্ষেত্রে মৃদু উপসর্গ হওয়া – এর পেছনে কোনো জেনেটিক কারণ কাজ করছে কিনা তা সম্প্রতি অনেকগুলো গবেষণা চালানো হচ্ছে। বিজ্ঞানীরা দেখেছেন, মানব জেনোমের দুটি বিন্দুতে যে পার্থক্য দেখা যায় – তার সাথে কোভিড-১৯ আক্রান্ত রোগী শ্বাসতন্ত্র বিকল হয়ে যাবার বর্ধিত ঝুঁকির সম্পর্ক আছে।
এই দুটি বিন্দুর একটি এমন কিছু জিন আছে যা মানুষের রক্তের টাইপ নির্ধারণ করে। করোনাভাইরাস সংক্রমণের রহস্য নিয়ে নতুন ভাবনা রিপোর্টে বলা হয়, ওই জরিপটি অন্য কিছু দিক থেকেও ছিল বিস্ময়কর। বলা হয়, মানুষের দেহকোষের বাইরের দিকে থাকা এ সি ই টু নামে একটি প্রোটিনের সাথে নিজেকে আটকে দিয়ে করোনাভাইরাস কোষের ভেতরে প্রবেশ করে। কিন্তু যারা কোভিড-১৯এ গুরুতর অসুস্থ হয়ে পড়েন – তাদের ক্ষেত্রে এ সি ই টু-র জেনেটিক পার্থক্য কোন ভূমিকা রাখেনি বলে গবেষকরা দেখতে পেয়েছেন।
“তার মানে হলো, যেসব দিকগুলোর দিকে আমরা অপেক্ষাকৃত কম নজর দিয়েছি হয়তো সেগুলোই কোভিড-১৯কে জীবনাশংকা তৈরির মতো পরিস্থিতিতে নিয়ে যাবার পেছনে বড় ভূমিকা রাখছে” – বলেন আন্দ্রে ফ্রাংক, যিনি এই জরিপের অন্যতম প্রণেতা, এবং জার্মানির কিয়েল বিশ্ববিদ্যালয়ের একজন জেনেটিক বিশেষজ্ঞ। বিজ্ঞানীরা এর মধ্যেই দেখেছেন যে আক্রান্তদের বয়স, এবং আগে থেকেই হাঁপানি, হৃদরোগ, বা ডায়াবেটিসের মত স্বাস্থ্যগত সমস্যা ছিল এমন লোকদের কোভিড-১৯এ গুরুতর অসুস্থ হওয়ার সম্ভাবনা বেশি।
আরো দেখা গেছে, করোনাভাইরাসে নারীদের চাইতে পুরুষরা বেশি মারা গেছেন। কিছু জরিপে জাতিগত ও নৃতাত্ত্বিক বৈশিষ্ট্যও ঝুঁকি বাড়ায় বলে দেখা গেছে। সম্প্রতি ব্রিটেনে কিছু গবেষণায় বলা হচ্ছে, করোনাভাইরাসে আক্রান্ত হলে বাংলাদেশি, পাকিস্তানি, ভারতীয় এবং কৃষ্ণাঙ্গদের মারা যাবার ঝুঁকি শ্বেতাঙ্গদের চাইতে বেশি।
(সূএ: বিবিসি)