॥ তানজিম আনোয়ার ॥
ঢাকা, ২৬ জুন, ২০২০ (বাসস) : সম্ভাব্য অর্থনৈতিক বিপর্যয় এড়াতে করোনা-পরবর্তী সময়ে সরাসরি বিদেশি বিনিয়োগকে আরো উৎসাহিত করতে নীতিমালা পুনবিন্যাস করতে যাচ্ছে সরকার।
এই মহামারীর প্রভাবে আগামীতে বিশ্ব বড় ধরণের অর্থনৈতিক বিপর্যয়ের কবলে পড়তে পারে বলে আশঙ্কা করা হচ্ছে। এ পরিস্থিতিতে বাংলাদেশ গত এক দশকের চলমান উন্নয়নধারা অব্যাহত রাখতে করোনা পরবর্তী সময়ে সরাসরি বিদেশি বিনিয়োগকে উৎসাহিত করতে এ উদ্যোগ নিচ্ছে।
এ নীতিমালায় সরাসরি বিদেশি বিনিয়োগকারীদের নতুন প্রণোদনা দেওয়ার পরিকল্পনা করা হয়েছে। এছাড়াও, কর অব্যাহতিসহ সহজ শর্তে বৈদেশিক বিনিয়োগের সুযোগ তৈরি করা হবে। সরকার নীতি নির্ধারণী বিশেষজ্ঞদের মতামতের ভিত্তিতে সিঙ্গাপুর ও জাপানের মত কম ক্ষতিগ্রস্থ দেশগুলো থেকে বিনিয়োগকারীদের আকৃষ্ট করার পরিকল্পনা করছে।
করোনা মহামারী পরিস্থিতিতে অনেক বিনিয়োগকারী চীন থেকে অন্যদেশে ব্যবসা স্থানান্তরের বিষয়ে ভাবছেন। বাংলাদেশের নীতিনির্ধারকরা এই সুযোগ কাজে লাগানোর সম্ভাব্য সুবিধাগুলো নিয়ে গবেষণা ও পরিকল্পনা করছেন।
বাংলাদেশ অর্থনৈতিক অঞ্চল কর্তৃপক্ষ (বেজা)’র নির্বাহী চেয়ারম্যান পবন চৌধুরী বাসস’কে বলেন, ‘আমরা করোনাকালে এবং করোনা উত্তর সময়ে বৈদেশিক বিনিয়োগকারীদের আকৃষ্ট করতে বিদ্যমান প্রণোদনা প্যাকেজের পাশাপাশি নতুন প্রস্তাবনা আনার সুপারিশমালা তৈরি করেছি।’
তিনি বলেন, বাংলাদেশের আরো বেশি প্রণোদনার সুযোগ দেওয়া উচিত, কারণ বিদেশি বিনিয়োগ আকৃষ্ট করার ক্ষেত্রে অন্যান্য আঞ্চলিক প্রতিযোগী দেশ যেমন- ভারত, ভিয়েতনাম, থাইল্যান্ড এবং কম্বোডিয়া আরো বেশি সুবিধা প্রদান করছে। এরই মধ্যে তারা বিভিন্ন দেশের সাথে বৈদেশিক বাণিজ্য চুক্তি (এফটিএ)’র মাধ্যমে কিছু বড় বাজার ব্যবস্থায় প্রবেশের সুযোগ পেয়েছে।
বেজা আঞ্চলিক প্রতিযোগী বৈদেশিক বিনিয়োগ গ্রহণকারী দেশগুলির সাথে তুলনা করে আরও নতুন কিছু প্রণোদনার প্রস্তাবনা সম্পর্কিত একটি প্রতিবেদন চূড়ান্ত সিদ্ধান্তের জন্য গত এপ্রিলের শেষ দিকে প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়ে জমা দিয়েছে।
উক্ত প্রতিবেদনে জি টু জি (সরকারের সঙ্গে সরকার) চুক্তির ভিত্তিতে অন্যান্য দেশ থেকে বাংলাদেশে বিনিয়োগ স্থানান্তরে আগ্রহীদের সম্পূর্ণ কর্পোরেট কর মওকুফ করাসহ সকল যন্ত্রপাতি আমদানিতে শুল্কমুক্ত সুবিধা দেওয়ার সুপারিশ করা হয়েছে।
বর্তমানে বেজা কিছু জাপানি বিনিয়োগকারীর সঙ্গে কাজ করছে যারা করোনা মহামারীর কারণে চীন থেকে তাদের বিনিয়োগ স্থানান্তর করার পরিকল্পনা করছে।
উক্ত প্রতিবেদনে সকল বিদেশি বিনিয়োগকারী রপ্তানিমুখী উৎপাদক ও বিদেশি বিনিয়োগকারীদের দশবছরের শতভাগ কর্পোরেট কর মওকুফের প্রস্তাব দিয়ে, দেশি বিদেশি উভয় বিনিয়োগকারীদের জন্য জমি ইজারা ও বন্ডেড গুদাম সুবিধার ক্ষেত্রে ভ্যাট মওকুফেরও পরামর্শ দেওয়া হয়েছে।
এই প্রতিবেদনে আরো প্রস্তাব করা হয়েছে যে, যদি কোন কোম্পানি ১০০ মিলিয়ন মার্কিন ডলার বিনিয়োগ করে অথবা ৩০০ জনের কর্মসংস্থান করে তাহলে ঐ কোম্পানি বাংলাদেশ সরকারের কাছ থেকে সাত বছরের জন্য কর সুবিধা পেতে পারে।
বেজা’র কার্যালয় সূত্র জানায়, কর্পোরেট করের হার ভারতে ২২ শতাংশ এবং ভিয়েতনাম ও থাইল্যান্ডে ২০ শতাংশ। এর প্রেক্ষিতে প্রস্তাবনায় স্থানীয় বিনিয়োগকারীদের জন্য কর্পোরেট করের হার বর্তমান ৩৫ শতাংশ থেকে ২৫ শতাংশে নামিয়ে আনার পরামর্শ দেয়া হয়েছে।
বিভিন্ন দেশের ভ্যাটের হার কম থাকায় প্রতিবেদনে ভ্যাটের হার ১৫ শতাংশ থেকে ১২ শতাংশে নামিয়ে আনার পরামর্শ দেওয়া হয়েছে। ভিয়েতনামে এই হার সাত শতাংশ এবং থাইল্যান্ড ও কম্বোডিয়ায় ১০ শতাংশ।
বেজা প্রধান বলেন, সরাসরি বিদেশি বিনিয়োগ আকর্ষণ করার জন্য বাংলাদেশ ওয়ান স্টপ সার্ভিস (ওএসএস) কেন্দ্রের মাধ্যমে অনলাইন সেবা প্রদান করায় অন্যান্য আঞ্চলিক প্রতিযোগীদের চেয়ে ভালো অবস্থানে আছে। এটি বর্তমান সরকারের জন্য একটি অন্যতম মাইলফলক।
পবন চৌধুরী বলেন ‘বর্তমানে আমরা অনলাইনের মাধ্যমে ১৭ টি বিভিন্ন সেবা দিচ্ছি যেখানে ভারত অনলাইনে পাঁচ থেকে ছয়টি এবং ভিয়েতনাম নয়টি সেবা অনলাইনের মাধ্যমে দিচ্ছে।”
তিনি বলেন, বেজা অনলাইনের মাধ্যমে শতভাগ সেবা প্রদানের পরিকল্পনা করছে। এতে যে কোন বিনিয়োগকারী এখানকার কোন অফিসে না এসেও সব ধরনের সেবা পাবেন।
পবন চৌধুরী আশা প্রকাশ করেন যে, সঠিক অগ্রাধিকার, একটি কর্ম পরিকল্পনা এবং সময়োপযোগী পদক্ষেপ গ্রহণের মাধ্যমে আকর্ষণীয় বৈদেশিক বিনিয়োগের জন্য বাংলাদেশ নিজেকে ‘অপ্রতিরোধ্য’ অবস্থানে নিয়ে যেতে পারে।
বাংলাদেশ উন্নয়ন কর্তৃপক্ষ (বিডা) কার্যালয় সুত্রে জানা যায়, সরাসরি বৈদেশিক বিনিয়োগকারী নতুন দেশগুলো আকর্ষণ করার জন্য বিনিয়োগের সুযোগ সুবিধা নিয়ে বিভিন্ন ব্রোশিওর ও হ্যান্ডবুক হালনাগাদ করা হচ্ছে। করোনা উত্তর সময়কে লক্ষ্য করে বিদেশি বিনোয়োগের উৎস দেশগুলোতে হালনাগাদকৃত হ্যান্ডবুক পাঠানো হবে।
বিডার প্রাক্তন নির্বাহী চেয়ারম্যান কাজী আমিনুল ইসলাম বলেন, বাণিজ্যিক কর্মকান্ড আরো সহজ করার ক্ষেত্রে অনেক উন্নতির সুযোগ রয়েছে। কারণ, বাংলাদেশ ২০২০ সালে ব্যবসা সহজীকরণের র্যাংকিং ‘ডুয়িং বিজনেস’ এ ১৯০ টি অর্থনীতির মধ্যে ১৬৮ তম স্থান অর্জন করেছে- যা আফগানিস্তানকে বাদ দিলে দক্ষিণ এশিয়ায় সর্বনি¤œ।
তিনি বলেন, ‘আমাদের মনে রাখতে হবে যে, বাংলাদেশ যদি তার ‘ডুয়িং বিজনেস’ র্যাংকিং না বাড়ায় তাহলে এই সংকটপূর্ণ মুহূর্তে এফডিআই আকর্ষণে অন্যান্য প্রচেষ্টা ব্যর্থ হতে পারে।’
তিনি বিদেশী বিনিয়োগকারীদের মূলধন ও মুনাফা স্বদেশে নেওয়ার ক্ষেত্রে আমলাতান্ত্রিক জটীলতা হ্রাস করার পরামর্শ দিয়েছেন। তিনি বলেন, ‘আমাদের নিশ্চিত করতে হবে যে বিদেশি বিনিয়োগকারীরা যেন তাদের বিনিয়োগ নিয়ে সহজ ভাবে আসা যাওয়া করতে পারেন।’
২০১৮-১৯ অর্থবছরে বাংলাদেশের এফডিআই ৫১ শতাংশ বৃদ্ধি পেয়ে ৩ দশমিক ৯ মার্কিন ডলারে দাঁড়িয়েছে। যা সর্বোচ্চ রেকর্ড। একই সময়ে মোট দেশজ উৎপাদন (জিডিপি)’র এফডিআই শেয়ারও ০ দশমিক ৯২ শতাংশ থেকে বৃদ্ধি পেয়ে ১ দশমিক ২৮ শতাংশে উন্নীত হয়েছে।
২০১৯-২০ অর্থ বছরের প্রথম সাত মাসে, জুলাই ২০১৯ থেকে জানুয়ারি ২০২০ পর্যন্ত নেট এফডিআই প্রবাহ ছিল ১ দশমিক ৬৯ বিলিয়ন মার্কিন ডলার। যা ২০১৮-১৯ অর্থ বছরের চেয়ে চার শতাংশ বেশি।
বাংলাদেশ ব্যাংকের সূত্র মতে, ২০১৮-১৯ অর্থবছরে চীন ছিল সবচেয়ে বড় বিনিয়োগকারী দেশ। তাদের নেট এফডিআই (সরাসরি বিদেশি বিনিয়োগ) প্রবাহ ছিল ১ দশমিক ১৬ বিলিয়ন মার্কিন ডলার। তারপরের অবস্থানে ছিল নেদারল্যান্ডসের ৮০২ দশমিক ৮ মিলিয়ন মার্কিন ডলারের বিনিয়োগ। এরমধ্যে জ্বালানি খাত সবচেয়ে বেশি পরিমাণে এফডিআই পেয়েছে। যার পরিমাণ ১ দশমিক ২৭ বিলিয়ন মার্কিন ডলার।