পুরো সপ্তাহ গরমের পর বৃহস্পতিবার সন্ধ্যা সাতটার সময় রাজধানীসহ দেশের অনেক জেলায় বৃষ্টি ও ঝড়ো হাওয়া বয়ে যায়। এর সঙ্গে হয় বজ্রপাতও, এতে নয়টি জেলায় প্রাণহানি ঘটে।
বজ্রপাতে সবচেয়ে বেশি মৃত্যু ঘটেছে সিরাজগঞ্জে। উত্তরাঞ্চলের এই জেলায় পাঁচজন মারা যান। ঢাকার যাত্রাবাড়ীতে মারা গেছেন দুই শিক্ষার্থী। এছাড়া রাজশাহীতে ৩, পাবনায় ৪, ব্রাহ্মণবাড়িয়ায় ৪ জন, গাজীপুরে ২, বগুড়ায় ২, হবিগঞ্জে ১, কিশোরগঞ্জে ৪, নাটোরে ২ জন মারা গেছেন।
কিন্তু নিহতের সংখ্যা আরও বেশি বলে আশংকা করা হচ্ছে।
সন্ধ্যে সাতটার পর সারা দেশেই তীব্র কাল বৈশাখী ঝড় শুরু হয়।
এসময় অস্বাভাবিক রকমের বেশি বজ্রপাত হয়েছে।
ছয় বছরে বজ্রপাতে নিহত হয়েছেন ১৪২০ জন। এর মধ্যে শিশু ২৭২ জন। নারী রয়েছে ২১৮ জন। আর পুরুষ রয়েছে ৯৩০ জন। দিন দিন বজ্রপাতে মৃত্যুর মিছিল দীর্ঘ হচ্ছে। দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা অধিদপ্তর, দুর্যোগ ফোরাম, গণমাধ্যমের তথ্য ও একাধিক স্বেচ্ছাসেবী সংস্থার হিসাব মতে এই তথ্য পাওয়া গেছে।
বাংলাদেশ আবহাওয়া অধিদপ্তরের কয়েক বছরের বজ্রপাতের ডাটা বিশ্লেষণ করে দেখা যায়, বাংলাদেশের মধ্য অঞ্চল অর্থাৎ ঢাকা, টাঙ্গাইল, কুমিল্লা, ময়মনসিংহ ও ফরিদপুর অঞ্চল এবং পশ্চিমাঞ্চল বৃহত্তর যশোর, কুষ্টিয়া ও খুলনা অঞ্চলে সবচেয়ে বেশি বজ্রপাতের ঘটনা ঘটেছে। সংশ্লিষ্টরা জানান, বৈশাখ- জ্যৈষ্ঠ থেকে শুরু করে শীতের আগ পর্যন্ত তাপমাত্রা বেড়ে যাওয়ায় প্রচুর জলীয় বাষ্প ঊর্ধ্বমুখী হয়ে মেঘের ভেতরে যায়। জলীয় বাষ্পের কারণে মেঘের ভেতরে থাকা জলকণা ও বরফ কণার ঘর্ষণের ফলে বজ্রপাতের সৃষ্টি হয়। সাধারণত মাটি থেকে আকাশের ৪ মাইল সীমার মধ্যে সবচেয়ে বেশি বজ্রপাতের ঘটনা ঘটে। ভয়াবহ এই বজ্রপাতের ছোবলে কিছু বুঝে ওঠার আগেই মারা যায় যে কোনো প্রাণী। এমনকি গাছের ওপর পড়লেও গাছটি মারা যায় কয়েকদিনের মধ্যেই।
যুক্তরাষ্ট্রের ক্যালিফোর্নিয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের এক গবেষণায় বলা হয়েছে, বিশ্বের গড় তাপমাত্রা এক ডিগ্রি সেলসিয়াস বাড়লে বজ্রপাত অন্তত ১৫ শতাংশ এবং ৪ ডিগ্রি সেলসিয়াস বাড়লে ৫০ শতাংশেরও বেশি বজ্রপাত হতে পারে। কয়েকটি দেশের হিসাব কষে এই ফল দেয়া হয়েছে।
রিপোর্টে বলা হয় কঙ্গোয় ভূমি থেকে এক হাজার মিটারেরও বেশি উচ্চতায় কিফুকা পর্বতের এক গ্রামে বিশ্বের সবচেয়ে বেশি বজ্রপাত হয়। বছরে প্রতি বর্গকিলোমিটারে দেড়শ বার। পরবর্তী অবস্থানে আছে ভেনিজুয়েলা, উত্তর ব্রাজিল ও যুক্তরাষ্ট্রের ফ্লোরিডা। বিশ্বে প্রতি সেকেন্ডে গড়ে ৪৫ বার বজ্রপাত হয়। সেই হিসেবে বছরে এ সংখ্যা প্রায় দেড়শ কোটি বার।
বজ্রপাতের কারণ ও প্রকৃতি সম্পর্কে বাংলাদেশ প্রকৌশল ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের এক প্রতিবেদনে দেখা যায়, একেকটি বজ্রপাতের সময় প্রায় ৬০০ মেগাভোল্ট বিদ্যুৎ প্রবাহিত হয়। অথচ একজন মানুষের মৃত্যুর জন্য মাত্র ১১০ ভোল্ট বিদ্যুৎ যথেষ্ট। সাধারণত আমরা বাসাবাড়িতে মাত্র ২২০ ভোল্ট ও শিল্প-কারখানায় ১২শ’ ভোল্টের বিদ্যুৎ ব্যবহার করে থাকি। এছাড়া, জাতীয় গ্রিডে ১১ হাজার ভোল্টের বিদ্যুৎ প্রবাহিত হয়।
এ ব্যাপারে আবহাওয়াবিদ ও বজ্রপাত বিষয়ক গবেষক বিজ্ঞানী আব্দুল মান্নান বলেন, বায়ুতে তাপমাত্রা বেশি থাকা, বাতাসে জলীয় বাষ্প বেড়ে যাওয়াসহ বায়ুতে অস্থিরতা বিরাজ করলে বজ্রপাতের ঘটনা ঘটে থাকে। ভৌগোলিকভাবে বাংলাদেশ এমন একটা জায়গায় অবস্থান করছে, যেখানে বজ্রপাতের আশঙ্কা অনেক বেশি।
এসএমআরসির বাংলাদেশ কার্যালয়ের এ বিজ্ঞানী বলেন, বিদ্যুৎ সব সময় পরিবাহী ব্যবহার করে। বজ্র বিদ্যুৎও তেমন পরিবাহী ব্যবহারের চেষ্টা করে। সেক্ষেত্রে যে এলাকায় বজ্রপাত হবে সেখানে বড় বড় গাছ থাকলে সাধারণত তার ওপরে পড়ে গাছকে পরিবাহী করে মাটি পর্যন্ত আসে। এছাড়া, যে কোনো বড় বড় টাওয়ারকেও পরিবাহী হিসেবে ব্যবহার করতে পারে যদি তাতে কোনো বজ্রনিরোধক যন্ত্র না লাগানো থাকে।
সংশ্লিষ্টরা বলছেন, বজ্রপাত কোনোভাবেই বন্ধ করা যাবে না। তবে বজ্রপাতকে মোকাবিলা করা সম্ভব। এর হাত থেকে রক্ষা পাওয়ার জন্য বাড়িতে বজ্রনিরোধক যন্ত্র লাগানো, বজ্রপাতের সময় বজ্র নিরোধক যন্ত্রওয়ালা বাড়িতে অবস্থান নেয়া, আকাশে মেঘ গর্জন বা বজ্রপাতের সময় মোবাইল ফোনে কথা না বলা ও সব ধরনের বৈদ্যুতিক সুইচ অফ রাখাসহ কিছু নিয়ম মেনে চললে বজ্রপাতের অপূরণীয় ক্ষতির হাত থেকে রক্ষা পাওয়া সম্ভব।
এছাড়া, আগেকার দিনে গ্রামাঞ্চলে বড় বড় গাছ দেখা যেতো যেগুলো বজ্রপাত থেকে লোকালয়ের মানুষগুলোকে রক্ষা করতো। ২০০৯ সাল থেকে বজ্রপাতের ওপর গবেষণা করছে এসএমআরসি।
সার্ক স্টর্ম প্রোগ্রাম নামের এ প্রকল্পের অধীনস্থ গবেষকদের পর্যবেক্ষণ অনুযায়ী, সার্কভুক্ত দেশগুলোর মধ্যে বজ্রপাতের সংখ্যা ও প্রাণহানির দিক দিয়ে সর্বোচ্চ ঝুঁকিতে রয়েছে বাংলাদেশ।
সার্কভুক্ত অন্য দেশের তুলনায় বাংলাদেশে বজ্রপাতে মৃত্যুর হার বেশি। সংস্থাটির ঢাকা কার্যালয়ের গবেষকদের পর্যবেক্ষণ অনুযায়ী, বাংলাদেশে প্রতিবছর বজ্রপাতে মারা যায় ৫০০ থেকে ৮০০ লোক। সার্ক আবহাওয়া গবেষণাকেন্দ্রের (এসএমআরসি) তথ্য অনুযায়ী, প্রতিবছর মার্চ থেকে মে পর্যন্ত বাংলাদেশে প্রতি বর্গকিলোমিটারে ৪০টি বজ্রপাত হয়। এতে বছরে মাত্র ১৫০ বা তার কিছু বেশি লোকের মৃত্যুর খবর গণমাধ্যমে ছাপা হয়। আসলে এ সংখ্যা ৫০০ থেকে ৮০০ হবে। তবে যুক্তরাষ্ট্রের ন্যাশনাল লাইটনিং সেফটি ইনস্টিটিউটের ২০১০ সালে প্রকাশিত এক প্রতিবেদনে দেখা যায় প্রতিবছর সারা বিশ্বে বজ্রপাতে যত মানুষের মৃত্যু ঘটে, তার এক-চতুর্থাংশ ঘটে বাংলাদেশে।
ঢাকার বাসিন্দারা জানিয়েছেন, এরকম তীব্র বজ্রপাত তারা তাদের স্মরণকালে দেখেননি।
রাজশাহীর জেলা প্রশাসক জানিয়েছেন সেখানে অন্তত পাঁচ জন বজ্রপাতে প্রাণ হারিয়েছেন।
সিরাজগঞ্জে চারজন এবং কিশোরগঞ্জে চার জন নিহত হয়েছেন বলে জানিয়েছেন সেখানকার কর্মকর্তারা।
এছাড়া ঢাকা, নাটোর, গাজীপুর থেকেও বজ্রপাতে নিহত হওয়ার খবর এসেছে।
বিলুপ্ত সার্ক আবহাওয়া গবেষণা কেন্দ্রের সাবেক পরিচালক সুজিত কুমার দেবশর্মা বলেন, কালবৈশাখী মৌসুমে বজ্রঝড় বেশি হয়। সাধারণত মার্চ থেকে মে মাস পর্যন্ত বজ্রঝড় হয়ে থাকে। বর্ষাকালের পর কখনও কখনও অক্টোবর-নভেম্বর মাসেও তা দেখা যায়। বাংলাদেশে প্রতি বছর বজ্রপাতে গড়ে দুই থেকে তিনশ’ মানুষের প্রাণহানি ঘটে বলে জানান তিনি।
আবহাওয়া অধিদপ্তর জানিয়েছে, বৃহস্পতিবার টাঙ্গাইলে ৩৭ মিলিমিটার সর্বোচ্চ বৃষ্টিপাত রেকর্ড করা হয়। এছাড়া নেত্রকোনা, কুমিল্লা, সিলেট, শ্রীমঙ্গল, রাজশাহী, ঈশ্বরদী, বগুড়া, বদলগাছী, তাড়াশ, রংপুর, দিনাজপুর, রাজাহাট, ভোলা ও পটুয়াখালীতে বৃষ্টি হয়েছে।
বৃহস্পতিবার দেশের সর্বোচ্চ তাপমাত্রা রেকর্ড হয়েছে মংলা ও যশোরে ৩৭ দশমিক ৮ ডিগ্রি সেলসিয়াস, ঢাকায় তাপপাত্রা ৩৬ ডিগ্রি সেলসিয়াসে উঠেছিল।
শুক্রবারের পূর্বাভাসে বলা হয়েছে, রাজশাহী, রংপুর, ঢাকা ও সিলেট বিভাগের কিছু কিছু জায়গায় এবং খুলনা, বরিশাল ও চট্টগ্রাম বিভাগের দুয়েক জায়গায় দমকা/ঝড়ো হাওয়াসহ বৃষ্টি অথবা বজ্রবৃষ্টি হতে পারে।
চলতি এপ্রিল মাসের ১৮ তারিখের মধ্যেই বজ্রপাতে মৃত্যু হয়েছে ৪৮ জনের। সংশ্লিষ্টরা বলছেন, জলবায়ু পরিবর্তন, অব্যাহতভাবে বড় বড় বৃক্ষ নিধনের পাশাপাশি পর্যাপ্ত গাছ লাগানো হচ্ছে না। তাই ভূ-পৃষ্ঠের তাপমাত্রা বৃদ্ধি পাওয়াসহ বাতাসে জলীয় বাষ্পের পরিমাণ বৃদ্ধি পাচ্ছে। যে কারণে সাম্প্রতিক বছরগুলোতে বজ্রপাতের পরিমাণও বৃদ্ধি পাচ্ছে। এতো মৃত্যুর পরও বজ্রপাতকে দুর্যোগের অন্তর্ভুক্ত করা যাচ্ছে না। বিশেষজ্ঞরা বলছেন, যেটার ক্ষয়ক্ষতি কমিউনিটির ভেতরে থেকে মোকাবিলা করা সম্ভব না তাকে দুর্যোগ বলে। যেমন বন্যা ও ঘূর্ণিঝড়। পক্ষান্তরে যে সমস্যার মোকাবিলা কমিউনিটির ভেতরে থেকেই করা সম্ভব তাকে দুর্যোগ বলা যায় না। যেমন বজ্রপাত। এটার মোকাবিলার জন্য সচেতনতাই যথেষ্ট। তাই বজ্রপাতকে দুর্যোগ হিসেবে স্বীকৃতি দেয়া সম্ভব হচ্ছে না। আবহাওয়া অধিদপ্তরের রেকর্ড অনুযায়ী, ২০১১ থেকে ২০১৫ সাল পর্যন্ত গত ৫ বছরে সারা দেশে ৫ হাজার ৭৭২টি বজ্রপাত হয়। এর মধ্যে ২০১১ সালে ৯৭৮, ২০১২ সালে ১ হাজার ২১০, ২০১৩ সালে ১ হাজার ৪১৫, ২০১৪ সালে ৯৫১ ও ২০১৫ সালে ১ হাজার ২১৮ বজ্রাঘাত হেনেছে বাংলাদেশে। বেসরকারি প্রতিষ্ঠান দুর্যোগ ফোরামের গণমাধ্যম থেকে সংগৃহীত রিপোর্টে দেখা যায় শুধু চলতি এপ্রিল মাসের ১৮ তারিখের মধ্যেই সারা দেশে বজ্রপাতে মৃতের সংখ্যা নারী-পুরুষ ও শিশু মিলে ৪৮ জন। এর মধ্যে শিশু ১৪, নারী ৩ ও পুরুষ ৩১ জন। গত বছর ২০১৫ সালে এই সংখ্যা ছিল ২৭৪ জন। এর মধ্যে শিশু ৫৪, নারী ৩৬ ও ১৮৪ জন পুরুষ। ২০১৪ সালে ৩৯ শিশু, ২৮ নারী ও ১৪৩ পুরুষ মিলিয়ে ২১০, ২০১৩ সালে ৫৫ শিশু, ৫৩ নারী ও ১৭৭ পুরুষসহ ২৮৫ জন মারা যায়। ২০১২ সালে মারা যায় ৩০১ জন, এর মধ্যে রয়েছে ৬১ শিশু, ৫০ নারী ও পুরুষ। ২০১১ সালে বজ্রপাতে মৃত্যুর সংখ্যা ছিল ১৭৯ জন, যার মধ্যে ৩১ শিশু, ২৮ নারী ও ১২০ পুরুষ। সংস্থাটির ২০১৫ সালের তথ্য অনুযায়ী চাঁপাই নবাবগঞ্জ, কিশোরগঞ্জ, লালমনিরহাট, সুনামগঞ্জ, সাতক্ষীরা, দিনাজপুর ও ব্রাহ্মণবাড়িয়ায় সবচেয়ে বেশি বজ্রপাতের ঘটনা ঘটেছে।
Leave a Reply